১১ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৬:৫৪

বেপরোয়া মনোভাব টেকসই হয় না

ফেলানীর লাশ ইতিহাসের বিষয়ই শুধু নয়, সীমান্ত হত্যার প্রতীক হয়ে রয়েছে। সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর মৃতদেহের ছবিটা কখনো ভোলা যাবে না। এ হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তখন ভারতের পক্ষ থেকে এ ঘটনার ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গত সাত বছরেও ফেলানী হত্যাকারীর শাস্তি হয়নি। এখনও উচ্চ আদালতে ফেলানী হত্যার বিচার চলছে। তবে প্রলম্বিত এই বিচারে ন্যায়বিচার কতটা হবে তা আমাদের জানা নেই। তবে ফেলানী হত্যার পর সীমান্তে হত্যা বন্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অনেক আলাপ-আলোচনা ও প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। বিএসএফ’র গুলীতে সীমান্তে প্রায়ই বাংলাদেশী নাগরিকরা নিহত হচ্ছেন। পৃথিবীর কোথাও সীমান্তে এতো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা লক্ষ্য করা যায় না। অথচ তারা আমাদের বন্ধু।

কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর লাশের ছবি দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় উঠে আসার পর ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) নিষ্ঠুরতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্তব্য প্রকাশ করতে থাকে বিবেকবান মানুষরা। তারা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে ‘মৃত্যর দেওয়াল’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘বার্লিন প্রাচীর’ আখ্যা দেয়। মানবাধিকার সংস্থা হিউমান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ’র বর্বরতার নিন্দা জানায়। ৭ জানুয়ারি ছিল সেই ফেলানীর হত্যাকা-ের ৭ম বার্ষিকী। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলাম বলেন, বিএসএফ সদস্যরা খুব কাছে থেকে তার চোখের সামনেই ফেলানীকে গুলী চালিয়ে হত্যা করে। বিএসএফ কোন প্রকার সতর্ক করা ছাড়াই গুলী চালায়। ওরা থামতে বললেই ফেলানী বেঁচে যেত।
উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ৯ মার্চ কাঞ্চনপুরের পুনারবাস সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা গুলী করে গোবিন্দ গৌতম নামে এক নেপালী নাগরিককে হত্যা করে। গোবিন্দকে শহীদ হিসেবে ঘোষণা করেছে নেপাল সরকার। নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও বহন করছে রাষ্ট্র। নেপাল সরকার এই হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। ভারতও এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বিএসএফ’র হত্যাকা- নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে তেমন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা যায় না। এ জন্যই কি বিএসএফ এতো বেপরোয়া?

বেপরোয়া মনোভাব আসলে কারো জন্যই কল্যাণকর নয়, নিজের জন্যও নয়। ট্রাম্প এর উত্তম উদাহরণ। কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে এমন আলোচনা-সমালোচনা কিংবা তামাশা হতে আমরা দেখিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে সমালোচনাপূর্ণ গ্রন্থ ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। বইটি প্রকাশ হোক তা চাননি ট্রাম্প। বরং বইটি আটকে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এসবের পরও বইটির বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। গত ৬ জানুয়ারি বইটির লেখক মাইকেল উলফ বলেছেন, গ্রন্থটিতে ট্রাম্প সম্পর্কে যে ধরনের তথ্য উঠে এসেছে, তাতে হোয়াইট হাউসে তার ক্ষমতার অবসান হতে পারে। মাইকেল উলফের বইতে বলা হয়েছে, ‘ট্রাম্পের মানসিক অবস্থা ঘুমন্ত’ বলে মনে করেন হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা। আর ট্রাম্প বলেছেন, বইটি ‘বিরক্তিকর এবং অসত্য’ তথ্যে ভরা। নিজের মানসিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে ট্রাম্প দাবি করেছেন তিনি প্রতিভাবান ও স্থিতিশীল।
এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত বইটিতে উলফ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সব বস্ত্র এক এক করে উন্মোচন করেছেন। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের যে ছবিটি উলফ এঁকেছেন তা একদিকে অদক্ষ, বিশৃঙ্খল এক প্রশাসনের ছবি, অন্যদিকে একে অপরের গলায় ছুরি বসাতে সদা ব্যস্ত এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিবরণ। উলফের উদ্ধৃতি অনুসারে রাজস্ব মন্ত্রী স্টিভ মিনুশিন ও সাবেক চিফ অব স্টাফ রেইন্স প্রিবাসের কথায়, ট্রাম্প একটি মুর্খ (ইডিয়ট)। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গ্যারি ফনের ভাষায়, ‘তিনি বিষ্ঠার ন্যায় বুদ্ধু (ডাস্ব এ্যাজ শিট)’। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকমাস্টারের ভাষায়, ‘লোকটা আস্ত আফিমখোর (ডোপ)’। বইটি যাতে প্রকাশ ও বিক্রি না হয় তার নির্দেশ দিয়ে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী চিঠি পাঠিয়েছেন। তার এই সিদ্ধান্তে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ মার্কিন গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যÑ মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এদিকে ট্রাম্পের আইনজীবীর চিঠির জবাবে গ্রন্থের প্রকাশক হেনরি হল্ট অ্যান্ড কোম্পানি তার প্রকাশনা তিন দিন এগিয়ে এনে শুক্রবার বাজারে ছেড়েছে। কোন কোন শহরে শুক্রবার মধ্যরাতের পর বইটি বিক্রি শুরু হলে কনকনে ঠা-া উপেক্ষা করে হাজার হাজার লোক বইয়ের দোকানে ভিড় জমায়। প্রকাশের আগেই বইটি বেস্ট সেলার হয়ে উঠেছে। মার্কিন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ভঙ্গ করে ট্রাম্প ওই পাগলামিটা না করলে বইটি হয়তো এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতো না। এ ক্ষেত্রেও ট্রাম্প আর একটা বড় বোকামির উদাহরণ সৃষ্টি করলেন।
ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি ছাড়াও ট্রাম্পকে এখন আর একটি বড় সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে, আর তা হলো রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাতের প্রশ্নটি। বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক টাইমস-এ এক উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে চারজন খ্যাতনামা আইনজীবী লিখেছেন, সব ঘটনাক্রম বিবেচনা করলে কোন সন্দেহ থাকে না যে, ট্রাম্প রাশিয়া প্রশ্নে বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন বছরের শুরুতেই নিজের অধিকাংশ বস্ত্র খুইয়ে বসে আছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প যে শুধু দেশের জনগণ কিংবা কাছের মানুষদের কাছেই বিরক্তিকর হয়ে উঠেছেন তা নয়, বেপরোয়াভাবে ক্ষতিকর নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছেও তিনি আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
সম্প্রতি জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়ে তিনি আতঙ্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিতর্কিত নানা সিদ্ধান্তের কারণে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ট্রাম্পের মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা তার সামগ্রিক সুস্থতা এবং কল্যাণ কামনা করি।

http://www.dailysangram.com/post/314823