১০ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:০৭

শীতে হাসপাতালে বাড়ছে রোগী

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভিড় বেড়েছে। শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধই বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে শীতকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রংকিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস, চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় অতিরিক্ত ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
শীতের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ। আর এসব রোগে মৃত্যু হয়েছে ৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮২৫ জন। তার আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৬০৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার এই তথ্য জানিয়েছে। তবে এর বাইরেও অনেকে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে এবং প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের তথ্যমতে, শীতের শুরু থেকে অর্থাৎ ১লা নভেম্বর ২০১৭ থেকে ৯ই জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত শীতজনিত রোগে সারা দেশে ৬৫ হাজার ৬০৪ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে এআরআই (অ্যাবস্ট্রাক্টিভ রিসপারেটরি ইনফেকশন অর্থাৎ শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ) এ আক্রান্ত হয়েছেন ১০ হাজার ৬৫৬ জন। এ রোগে মারা গেছে ৫ জন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪ হাজার ৭৪ জন, এতে মারা গেছে একজন। এছাড়া অন্যান্য রোগ যেমন নিউমোনিয়া, আমাশয়, জ্বর, কাশি ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ৮৭৪ জন। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় এসব রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৮২৫ জন। এরমধ্যে এআরআইয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১২৪ জন, ডায়রিয়ায় ৪৪৬ জন ও অন্যান্য রোগে ২৫৫ জন। এদিকে আইসিডিডিআরবির সূত্র মতে, শীতের প্রকোপ বাড়ার পর গড়ে প্রতিদিন ৪শ’ ডায়রিয়ার রোগী মহাখালীর হাসপাতালে আসছে। এরা মূলত শীতজনিত (রোটা ভাইরাস) ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা গড়ে ৬৫ ভাগ ও প্রাপ্তবয়স্ক ৩৫ ভাগ।

ঢাকা মেডকিলে কলেজ হাসপাতালে শিশু বিভাগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেশব্যাপী চলমান শৈত্যপ্রবাহের কারণে তীব্র শীতে ছোট শিশুরা ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা, অ্যালার্জি ও অন্যান্য এআরআই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ এসব শিশুর বিনামূল্যের ওষুধ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বিষয়টি হাসপাতাল পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের একাধিকবার জানানো হলেও সরবরাহ না থাকার অজুহাত দেখিয়ে দায় সারছে। তারা বলেন, হাসপাতালে প্রতি বছর কোটি টাকার ওষুধ কেনা হলেও শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ না থাকার বিষয়টি পীড়াদায়ক।
শীতে শিশু ও বৃদ্ধদের অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রংকিওলাইটিস, নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত গরম কাপড়সহ হাতমোজা, পামোজা পরিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু চিকিৎসক। সর্বক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করার কথা বলেছেন তারা। তার পরেও যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্টে ঘুমাতে না পারে, ঠোঁট-মুখ নীল হয়ে যায়, বুক স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ওঠানামা করে তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
শীতজনিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় অ্যাবস্ট্রাক্টিভ রিসপারেটরি ইনফেকশন বা শ্বাসযন্ত্রজনিত সমস্যায়। এ প্রসঙ্গে রিসপারেটরি বিশেষজ্ঞ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া মানবজমিনকে বলেন, বৃদ্ধ ও শিশু উভয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। কারণ এ দুই বয়সে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। হাসপাতালেও এ ধরনের রোগী আগের তুলনায় দ্বিগুণ আসতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, শীতে বাত ও চর্মজাতীয় রোগও বেড়ে যায়। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, বাড়ি-ঘর নির্মাণ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে শীতে বায়ুদূষণ বেশি হয়। কুয়াশার মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়াই ভালো। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সরিষার তেল ব্যবহার করা ভালো। পেট্রোলিয়াম জেলি ও ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত। রাস্তায় বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।

এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, দেশে এ বছর শীতের তীব্রতা বেশি। স্বাভাবিক শীতকালীন রোগব্যধির পাশাপাশি তীব্র শীতে বাতজনিত রোগ হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই মানুষের শরীরের তাপ উৎপাদন ক্ষমতা কমতে থাকে। তীব্র শীতে বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর শরীর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে আসে। শরীরে তাপ উৎপাদন কম হওয়ায় হাত-পা কুঁকড়ে যায়। এমনকি শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে। এছাড়া হাঁপানি, ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ অন্যান্য রোগ তো আছেই। এসব রোগ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই শীত এড়িয়ে চলতে হবে। গরম পোশাক পরতে হবে, গরম পানি খেতে হবে। এমনকি গোসলের ক্ষেত্রে গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু এসব রোগে বয়স্ক ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে তাই তাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। গ্রামের দরিদ্র মানুষরা শীতবস্ত্রের অভাবে অনেক সমস্যায় থাকেন। তাদের জন্য সমাজের বিত্তবানদের একটু এগিয়ে আসলে তারা উপকৃত হবেন। এক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের বাচ্চাদের জন্য শীতবস্ত্র এবং বড়দের জন্য কম্বল হলে বেশ উপকারে আসে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=99922