১০ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:০৫

এক বছরে বন্ধ হয়েছে ২৮৪টি কারখানা

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কলকারখানা। সময় মতো ব্যাংক ঋণ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ার কারণেই প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকসানের মুখে দেউলিয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে দেউলিয়া ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে করে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। রুগ্ন শিল্পকে নতুন করে বিনিয়োগে ফিরিয়ে আনতে না পারায় ঝুঁকি বাড়ছে ব্যাংকিং খাতেও।
গত এক বছরেই ব্যবসা গুটিয়েছেন ২৮৪ টি কারখানার মালিক। এসব কারখানার অধিকাংশই হলো তৈরি পোশাক কারখানা। প্লট না পাওয়ায় বন্ধ হয়েছে ৬০টি ট্যানারি কারখানা। আর গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে আরও ৫৪ টি কারখানায়। এতে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে আরও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হওয়ার উপক্রম প্রায় আরো ২ হাজার শিল্প কারখানা।

এসব কারখানার সবধরনের দায়দেনা থেকে অব্যাহতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে পোশাক মালিকদের সংগঠন, বিজিএমইএ। বিশ্লেষকরা বলছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হয় প্রতিযোগিতা করেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময় মত গ্যাস না পাওয়া এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না তারা। একই সাথে ব্যাংকের উচ্চ সুদ হারের কারনেই ব্যবসা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে তারা সরকারের সাথে কথা বলেও কোন সুরাহ করতে পারেনি। তাই দেউলিয়া হওয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই।
জানা গেছে, এমন বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে গ্যাস সংযোগের অপেক্ষায় রয়েছে পাঁচ বছর। কিন্তু উৎপাদনে যেতে পারেননি। প্রতি মাসেই ব্যাংক ঋণের সুদ গুণতে হচ্ছে। এতে করে উৎপাদনে যাওয়ার আগেই দেউলিয়া হচ্ছেন তারা। এসব ঘটনায় প্রায় ১৮ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। কিন্তু মামলার কোন সুরহা না হওয়ায় মুক্তি পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা।

তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা থেকে মধ্য আয়ের অভিযাত্রা দেশের অর্থনীতিকে সামনে টেনে নেওয়ার যে গল্প, তার সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে তৈরি পোশাক শিল্প। আশির দশকে শুরু হওয়া এ শিল্পের বিকাশের পথটা সহজ ছিল না মোটেও। যখন তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক বিক্ষোভ কিংবা কারখানার দুর্ঘটনা সবমিলিয়ে ঝুঁকি ছিল সবসময়ই। সাথে সম্প্রতি ক্রেতা ধরে রাখতে যোগ হয়েছে কারখানা পুনর্গঠনের বাড়তি খরচ। যার সাথে পেরে উঠছেন না অনেকেই। তাই সময় যত যাচ্ছে, লম্বা হচ্ছে ব্যবসা গুটানোর তালিকাও।
পোশাক মালিকদের সংগঠন, বিজিএমইএর তালিকাভুক্ত তৈরি পোশাক কারখানা এখন সাড়ে চার হাজার। যার মধ্যে পুরোদমে কাজ করছে তিন হাজারের মতো, বাকিগুলো চলছে ঢিমেতালে। আর বিভিন্ন সময়ে একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে ২৮৪টি কারখানা। সুদে আসলে যাদের ঋণের পরিমাণ ২৫৯ কোটি টাকা। সম্প্রতি সেই দায়দেনা থেকে অব্যাহতি চেয়ে মালিকদের পক্ষে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বিজিএমইএ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হয়। বন্ধ কারখানার দায় তাই কোনভাবেই সরকারের নয়। অ্যাকর্ড এলায়েন্স, ন্যাশনাল একশন প্লানের আওতায় কারখানাগুলোকে সংস্কারের জন্য খরচ করতে হয়েছে ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত।

বর্তমানে সারাদেশে দু'হাজার শিল্প-কারখানার মালিক গ্যাস সংযোগের আবেদন করে প্রতীক্ষায় রয়েছেন। যথাসময়ে সংযোগ না পেয়ে এরই মধ্যে অনেকে ঋণখেলাপির খাতায়। চালু বহু কারখানা নির্ধারিত চাপে গ্যাস পায় না। এ জন্য কেউ কেউ সিলিন্ডার গ্যাসও ব্যবহার করেন কারখানায়। শুধু গ্যাস নয়, বহু কারখানা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎও পায় না। কয়েক বছর ধরে শিল্প উৎপাদনও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। মূল কারণ গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘাটতি।
বহু বছর চেষ্টার পর ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গ্যাস সংকটে পুরোপুরি চালু হয়নি এই চামড়া শিল্পনগরী। যেসব কারখানা গ্যাস সংযোগ পায়নি তারা বিকল্প হিসেবে ডিজেল ও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। আবার সংযোগ পাওয়া কারখানাগুলোতেও গ্যাসের চাপ কম থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। সিলেটের খাদিমনগর বিসিকে বরাদ্দ পাওয়া ৯০টি শিল্প প্লটের মধ্যে চালু হয়েছে ৬৮টি। গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় বাকি প্লটগুলোতে কারখানা স্থাপিত হয়নি।
জানা গেছে, সাভারের ট্যানারি নগরীতে প্লট বরাদ্দ পেয়েছে ১৫৪ টি প্রতিষ্ঠান। বাকি প্রায় ৬০ প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ব্যাংক ঋণের ঘানি তাদের টানতে হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান এখন নতুন করে রুগ্ন কারখানার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এ ঘটনায় বেকার হয়েছে আরও পাঁচ হাজার শ্রমিক। যারা সাভারে কার খানা স্থনান্তর করেছে তারা এখনও গ্যাস সংযোগ অনেকে পায়নি। এতে করে তাদের মধ্যেও অনেকে রুগ্ন হচ্ছেন।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস-২০১৭ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্পে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্ভোগ পোহানোর রেটিংয়ে ১৯০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৭তম।
উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটকে চিহ্নিত করেছেন। গ্যাস সংযোগ প্রায় বন্ধ থাকায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করা যাচ্ছে না। এতে নতুন কারখানা স্থাপনের ঝুঁকি নিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। উদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ শিল্প খাতের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে ব্যাপকভাবে। উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থান।

ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম এলাকার শিল্প কারখানায় বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট। এসব এলাকায় দিনে কমপক্ষে তিন-চার ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। দিনের বেলা অধিকাংশ সময় গ্যাসের চাপ থাকে না। আবার যখন গ্যাসের চাপ থাকে তখন দেখা যায় শ্রমিকদের রুটিন কাজের সময় পেরিয়ে গেছে। ফলে তাদের বাড়তি সময় কাজ করতে হচ্ছে। এতে উদ্যোক্তাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিল্প কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের বিষয় অনেক পুরনো। উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল গ্যাস সরবরাহ সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা পিছিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না হলে ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক রফতানি ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
একজন শিল্পোদ্যোক্তা জানিয়েছেন, গ্যাস সংকটের কারণে কারখানার বয়লার চালাতে হচ্ছে ডিজেল দিয়ে। এতে খরচ পড়ছে খুব বেশি। ডিজেলভিত্তিক বয়লারে ইউনিটপ্রতি খরচ হচ্ছে ৪৬ টাকা। যেখানে গ্যাসে চালালে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ সাড়ে তিন টাকা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন-বিটিএমএ নেতারা জানিয়েছেন, টেক্সটাইল খাত পুরোপুরি গ্যাস-বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদন ভীষণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন শিল্প সম্প্রসারণ হচ্ছে না। বিনিয়োগের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে।
এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) প্রেসিডেন্ট আবদুুস সালাম মুর্শেদী বলেন,মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে প্রতিয়োগিতায় টিকে থাকতে না পেরে অনেকেই কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে আবার দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। উৎপাদন পরিবেশ না থাকলে কারখানা বন্ধ হতে বাধ্য।
তিনি আরও বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে দেশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা হচ্ছে না। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। জ্বালানি খাতে উদ্যোক্তাদের ব্যয় বাড়ছে। ফলে বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না তারা।

এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ায় বিদ্যুৎ সংকট কিছুটা কেটেছে। তবে এখনও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গ্যাস সংকট আগের মতোই আছে। বরং ইদানীং তা বেড়েছে। তিনি জানান, সরকার তাদের আশ্বস্ত করেছে শিল্প খাতে গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যা আগামী বছরে সহনীয় পর্যায়ে আসবে।
বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দিনে ৩৫০ কোটি ঘনফুটের ওপরে। উৎপাদন হয় ২৭০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি ৮০ কোটি ঘনফুট। এ জন্য নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। শিল্পে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে খুব সীমিত আকারে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটির মাধ্যমে অনেক যাচাই-বাছাই করে মাঝেমধ্যে কিছু কারখানাকে গ্যাস সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির অনুমতি দেওয়া হয়। গত মে মাসে এই কমিটি প্রায় দেড় বছর পর ২৭৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে নতুন গ্যাস সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে ১৬৭টি শিল্প নতুন সংযোগ এবং ১০৬টিতে গ্যাসের লোড বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, গ্যাস সংযোগ অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় দুই হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান। এলএনজি আমদানি শুরু হলে এই কারখানাগুলো আগামী এপ্রিলের পর সংযোগ পাবে।
জ্বালানি উপদেষ্টা ডিসিসিআইয়ের এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি জানিয়েছেন, এলএনজি এলে আগামী বছর গ্যাসের সংকট ৫০ শতাংশ দূর হবে। তবে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পেতে আরও তিন-চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। এই মধ্যবর্তী সময়ের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে সরকার সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে আগামী জুনের মধ্যে বেশ কয়েকটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে।বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৩ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ আট থেকে নয় হাজার মেগাওয়াট।

 

http://www.dailysangram.com/post/314678