জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনরত এবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা
৯ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৭:৫৯

এবার আমরণ অনশনে ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকেরা

নিজেদের প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে এবার আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়েছেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকেরা। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা আট দিন অবস্থান ধর্মঘটের পর গতকাল এ আমরণ অনশনের ঘোষণা দেন বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতির নেতারা। আজ বেলা ১১টা থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু হবে।

গতকালও সারা দেশ থেকে আসা শিক্ষক-শিক্ষিকা জানান, আমাদের দাবি একটাইÑ জাতীয়করণ করতে হবে, রাজপথ ছাড়ব না, বেতন ছাড়া যাব না, বেতন দিন নইলে মেরে ফেলুন, পাঠদান করি বেতন পাব না কেন, বিমাতাসুলভ আচরণ মানি না মানব না প্রভৃতি সেøাগান লেখা পোস্টার নিয়ে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন।
মাদরাসা বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃত দেশের সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষকেরা। সমিতির সভাপতি কাজী রুহুল আমিন চৌধুরী বলেন, খোলা আকাশের নিচে মরে যাব, তবু দাবি আদায় না করে ফিরব না। সরকার ২০১৩ সালে এক ঘোষণায় রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলসহ সারা দেশের ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করল। কিন্তু ইবতেদায়ি মাদরাসা যে অন্ধকারে ছিল সেখানেই রয়ে গেল। তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে সরকার সারা দেশের সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুল ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের মাসে ৫০০ টাকা ভাতা নির্ধারণ করে। পরে ধাপে ধাপে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করতে করতে ২০১৩ সালে সব জাতীয়করণ করা হলো; কিন্তু আমাদের করা হলো না। অপর দিকে প্রথমে সব ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকদের ভাতা দেয়ার কথা বলা হলেও পরে মাত্র এক হাজার ৫১৯টি মাদরাসার শিক্ষকদের ভাতা দেয়া হয়।

শিক্ষকেরা বলেন, যুগের পর যুগ আমরা বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে আসছি। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সমান দায়িত্ব পালন করছি আমরা। সরকারি স্কুলের শিক্ষাথীদের মতো আমাদের মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও সমান সুযোগ-সুবিধা পায়; কিন্তু আমাদের কোনো বেতন নেই। সরকার সারা দেশের সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলসহ ২৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করল; কিন্তু ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রতি চূড়ান্ত বৈষম্য করা হলো। এ বঞ্চনা-বৈষম্য আর মেনে নেয়া হবে না। প্রয়োজনে রাজপথে জীবন দেব, তবু দাবি আদায় না করে ফিরব না।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গতকাল কয়েক হাজার শিক্ষক কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাদের সাথে কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন মাদরাসার অনেক নারী শিক্ষক। তীব্র শীত উপেক্ষা করে অনেকে দিনরাত রাজপথে অবস্থান করছেন। মাইকে অনরবত বক্তব্য প্রচার করে শিক্ষকদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা চলছে। অনেক শিক্ষক জানিয়েছেন, তাদের ২৫-৩০ বছর ধরে বেতনহীন জীবনের বঞ্চনার কথা। কেউ কেউ বক্তব্য দেয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়ছেন দুঃখের কথা বলতে গিয়ে। জালালউদ্দিন মোল্লা নামে ৭৫ বছর বয়সী এক শিক্ষক এসেছেন দৌলতপুর মানিকগঞ্জ থেকে। তিনি আলহাজ মানছুরিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি দুই দিন ধরে আছেন এখানে। শরীরে আর কুলাচ্ছে না। ১৯৮২ সালে মাদরাসাটি তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং শুরু থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আজ অবধি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বেতনভাতা পাননি তিনি। জালালউদ্দিন বলেন, তার নিজের যা জমিজমা আছে তার আয় দিয়ে এক হাজার টাকা করে মাসে বেতন দেন শিক্ষকদের। কিন্তু এত কম টাকায় কেউ থাকতে চায় না। কিছু দিন পর শিক্ষকেরা চলে যান। আবার নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেন। এভাবেই চলছে। মাদরাসা জাতীয়করণ হলে তিনি কোনো সুবিধা পাবেন না জেনেও দাবি নিয়ে এসেছেন নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটি যদি টিকে থাকে সেই আশায়।
১৯৯৪ সালে মাদরাসা বোর্ড ১৮ হাজার ১৯৪টি মাদরাসা রেজিস্ট্রেশন দিলেও সরকারের অবহেলায় পরে ১২ হাজারের বেশি মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে সারা জীবন বিনা বেতনে চাকরি করে অবসরে চলে গেছেন। মাদরাসা বোর্ডের ২০১৬ সালের তথ্য অনুসারে সারা দেশে মাত্র ছয় হাজার ৯৯৮টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা ছিল। তবে সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, এর বাইরে আরো অনেক মাদরাসা রয়েছে যা তালিকাভুক্ত হয়নি এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক মাদরাসাও চালু হয়েছে জাতীয়করণের আশায়।
নোয়াখালীর চাটখিলের দক্ষিণ দশগুনিয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রধান শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমার আগে আরো দুজন প্রধান শিক্ষক অবসরে চলে গেছেন কোনো বেতনভাতা ছাড়া। তিনিও কোনো ভাতা পান না। আবদুল্লাহ আল মামুন কামিল পাস।

জাহিদ হাসান এসেছেন লাভা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা নকলা শেরপুর থেকে। কামিল পাস করে তিনি নয় বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন একদিন জাতীয়করণ হবে এই আশায়। জামালপুরের মদনেরচর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষক ওমর ফারুক ২১ বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন। তিনি বলেন, তার মাদরাসা থেকে এবার সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
সমিতির সহসভাপতি মো: তাজুল ইসলাম ফরাজী বলেন, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের বিভিন্নপর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রী, মন্ত্রণালয়, মাদরাসা বোর্ড, অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বারবার আমাদের বৈঠক হয়েছে। সব বৈঠকেই সরকারের তরফ থেকে মাদরাসাগুলো টিকিয়ে রাখাসহ জাতীয়করণের দাবির পক্ষে মত দিয়েছেন। নানা সময়ে নানা ধরনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে জাতীয়করণের লক্ষ্যে। কিন্তু বারবার মাঝপথে গিয়ে আটকে গেছে বিষয়টি। তাই এবার বাধ্য হয়ে আমরা অনশন কর্মসূচি দিয়েছি। আমরা চাই সরকার যেমন এক ঘোষণায় ২৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করেছে, তেমনি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসাও জাতীয়করণ করা হোক। এ বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/283361