৯ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৭:৫৪

অনুতপ্ত মাহাথির কাঁদলেন কারাবন্দী আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য

মালয়েশিয়ার দুই কিংবদন্তী পুরুষের নাম মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিম। ৯০ এর দশকে হাতে হাত রেখে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন উভয়ে। কিন্তু এক সময় দূরত্ব তৈরি হতে থাকে দুইজনের মধ্যে। আদর্শিক দিক থেকে বলতে গেলে একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হন এক পর্যায়ে এসে। শত্রুতা তৈরিতে অবশ্য প্রধান ভূমিকা ছিল মাহাথিরেরই।

ইসলামপন্থী আনোয়ার থেকে দূরে থাকতে এবং নিজের পশ্চিমামুখী রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করেন মাহাথির। সমকামিতার অভিযোগ এনে আনোয়ারকে জেলে ঢুকানো হয়। যদিও সৎ ও অত্যন্ত ধার্মিক হিসেবে পরিচিত আনোয়ারের বিরুদ্ধে এমন হাস্যকর অভিযোগ আনার কারণে সমালোচিত হয় তৎকালীন সরকার। মাহাথির মোহাম্মদের সরকারের দ্বারা বহু বছর জেল খাটার পর মুক্তি পেয়ে আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ইসলামপন্থী এই নেতা।
এরপর ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দল। ওই নির্বাচনে অনেকটা চমক দেখিয়ে প্রধান বিরোধীদল হয় আনোয়ার ইব্রাহিমের রাজনৈতিক দল। তার জনপ্রিয়তা রাজাকের জন্য সমস্যা ছিলো। তাই আবারও সেই আগের মতো করে সমকামিতার অভিযোগ! এবারও জেলে আটকে রেখে বিচার করা হয় তার। বর্তমানে আনোয়ার জেল খাটছেন। যদিও মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাকে দেয়া দ-ের সমালোচনা করেছে বিচারপ্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকার কারণে।

নাজিব রাজাকের সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় এখন আন্দোলন চলছে। এমন অবস্থায় আগামী নির্বাচনে তাকে মোকাবেলার জন্য বিরোধীদলগুলো জোট গঠন করেছে। সেই জোটের প্রধান নেতা হচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তাতে যোগ দিয়েছে মাহাথিরের দলও। নির্বাচনের তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়নি। তবে আগামী আগস্টের মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাদকতা রয়েছে।
রবিবার আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন জোট পাকাতান হারাপান নির্বাচনের জন্য তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। এতে মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী ও আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহকে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে জোট। মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এমন ঘোষণা প্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মনোনয়নের মূল ক্ষমতা আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে। তাকে বিনা অপরাধে তাকে জেল খাটানো মাহাথিরকে তিনি কিভাবে তার জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারেন! কিন্তু আনোয়ার তা-ই করলেন। দেশ ও দলের স্বার্থে নিজের অতীত কষ্টের কথা ভুলে মাহাথিরকেই প্রার্থী হিসেবে মেনে নিলেন।

এক সময় শত্রুতা করলেও রবিবার এই ঘোষণার পর আবেগাপ্লুত হয়ে যান উন্নয়নের জন্য মালয়েশিয়ার কিংবদন্তীতূল্য এই নেতা। নাম ঘোষণার পর উপস্থিত দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এসময় পাশে থাকা তার স্ত্রী সিতি হাসমান কেঁদে ফেলেন। টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মুছতে থাকেন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে সিতির পাশে গিয়ে বসেন আনোয়ার ইব্রাহিমের স্ত্রী আজিজাহ। সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে তিনিও কেঁদে ফেলেন। হলরুমের অনেকের চোখ তখন ভিজে উঠেছে। এক পর্যায়ে নিজে ধরে রাখতে পারেননি মাহাথির মোহাম্মদও। টলমল চোখ নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে কান্না লুকানোর চেষ্টা করেন তিনি।
কিছুক্ষণ পরে বক্তব্য দেয়ার জন্য মঞ্চে উঠেন মাহাথির। উঠেই প্রথমে বলেন, ‘আমি আনোয়ারের কাছে ঋণী। তার অনুভূতি আমি অনুভব করতে পারছি। যখন আমার সরকারের সময়ে তাকে সুনগাই বুলো কারাগারে পাঠানো হয়েছিল তখন ওর কেমন লেগেছে আমি অনুভব করতে পারছি। গত ২০ বছরে তার পরিবার অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছে। আমি তাদের অনুভূতিটাও বুঝতে পারছি। আমাকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত তার জন্য খুব সহজ ছিল না।’

‘আমরা এখন একের অন্যের সাথে হাত মিলিয়েছি। কিন্তু তার পক্ষে আমাকে মেনে নেয়া সহজ নয়। কারণ আমি তখন নেতৃত্বের অংশ ছিলাম। এ কারণে আজকের সিদ্ধান্ত নিতে আমরা অনেক সময় নিয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত আনোয়ার আমাদের দেশের জন্য করা সংগ্রামকেই প্রাধান্য দিয়েছে। আমি তার কাছে ঋণী’, বলেন মাহাথির।
এতটুকু বলার পর হলরুম কতালিতে মুখর হয়ে ওঠে। এরপর জোটের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, নির্বাচনে জিততে পারলে তাদের সরকারের প্রথম কাজ হবে আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য সাধারণ ক্ষমার ব্যবস্থা করা। এবং এর মাধ্যমে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ খুলে দেয়া।

http://www.dailysangram.com/post/314542