৯ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৭:৫০

রাজধানী শহর বসবাসের উপযোগী হতে হয়

সুশাসন

ইকতেদার আহমেদ

পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশগুলোতে রাজধানী শহরের জনসংখ্যা সীমিত রাখার প্রয়াসে শহর বা শহরের আশপাশে বড় ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয় না। রাজধানী শহর হয়ে অপর কোনো পার্শ্ববর্তী বা দূরবর্তী শহরে যেতে হলে শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পার্শ্বপথের (বাইপাস) ব্যবস্থা করা হয়। রাজধানী শহরের চার পাশে উপশহর গড়ে তোলা হয়, যাতে রাজধানীতে কর্মজীবী মানুষ স্বল্পসময়ে তাদের কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করতে পারে। রাজধানী শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে কর্মজীবী ও শহরে বসবাসরত মানুষ যেন দ্রুত বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্টেশন ও নৌবন্দরে পৌঁছাতে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে বিরতিহীন ট্রেন ও বাসের ব্যবস্থা করা হয়। সচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য ট্যাক্সিক্যাবে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এসব ট্যাক্সিক্যাব টোলযুক্ত সড়ক দিয়ে চলাচলের কারণে এগুলোতে যানবাহনের চাপ অপেক্ষাকৃত কম থাকে। শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাওয়ার জন্য বিরতিহীন ও বিরতি দিয়ে উভয় ধরনের বাস ও ট্রেনের ব্যবস্থা থাকে। শহরের মধ্যে চলাচলকারী যানবাহনের গতি যাতে শ্লথ না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখে ইউটার্নের পরিবর্তে ইউলুপ, ওভারপাস ও আন্ডারপাসের ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শহরের কেন্দ্রস্থলের পরিবর্তে প্রান্তে গড়ে তোলা হয়। সড়কপথে যানবাহনের চাপ কমানোর নিমিত্তে বিদ্যালয়পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে বিদ্যালয়ের বাসে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা ও কারিগরি মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহনযোগে আসা-যাওয়া করে। এসব প্রতিষ্ঠানের আবাসিক শিক্ষার্থীরা সচরাচর ছুটির দিন ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অঙ্গন ত্যাগ করে না। দেশের সাধারণ মানুষকে তাদের বিভিন্নধর্মী সমস্যা সমাধানের জন্য যেন কোনো দফতরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে না হয়, সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত প্রতিকার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এসব বিষয় মাথায় রেখে রাজধানী শহরের নগর পরিকল্পনা করার কারণে সেখানে বসবাস ও চলাফেরা উভয় স্বস্তিদায়ক হয়।
উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের রাজধানী শহরে বসবাসরত নাগরিকেরা যেন স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারে, তা নিশ্চিতকরণে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শহরের বর্জ্য নির্ধারিত সময়ে অপসারণ করা হয়। বর্জ্য অপসারণের সময় শহরের নাগরিকেরা যেন কোনো ধরনের অস্বস্তির মধ্যে না পড়ে, তা চিন্তায় রেখে এ কাজটি শেষ রাতের দিকে সম্পন্ন করা হয়। তা ছাড়া এসব দেশে যানবাহনে করে বর্জ্য পরিবহনকালীন তা থেকে কোনো ধরনের উৎকট গন্ধ নির্গত হয় না এবং বর্জ্য থেকে দুর্গন্ধযুক্ত পানি নির্গত হয়ে সড়কে পড়ে না। অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে জৈব বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ও সার প্রস্তুতে ব্যবহার হয়। অজৈব বর্জ্য রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নবায়ন করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা হয়।

উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের রাজধানী শহরের যেকোনো নির্মাণস্থল থেকে মাটি অপসারণের প্রয়োজন হলে তা কাভার্ডভ্যানের মাধ্যমে অপসারণ করা হয় এবং অপসারণস্থল থেকে কাভার্ডভ্যানটি শহরের সড়কে ওঠার আগে এটির চাকা পানি দিয়ে এমনভাবে পরিষ্কার করা হয়, যাতে চাকার সাথে লেগে থাকা কাদা বা মাটি দিয়ে সড়ক কর্দমাক্ত বা ধুলায়িত না হয়। এসব দেশে কাভার্ডভ্যানে করে মাটি পরিবহনকালীন কখনো ভ্যান থেকে মাটির খণ্ড সড়কে পড়ে সড়ককে কর্দমাক্ত বা ধুলায়িত করে না।
উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের নর্দমা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়, যাতে অধিক বৃষ্টির কারণে নর্দমা বা পয়ঃনিষ্কাশনের পথ উপচে পানি সড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত না হয়।
রাজধানী শহর হিসেবে পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের তুলনায় আমাদের রাজধানী শহর ঢাকায় যারা বসবাস করছেন, তাদের বসবাস ও যাতায়াত মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। ঢাকা শহরের আয়তনের তুলনায় শহরটিতে যে সংখ্যক লোক বসবাস করে, সে হিসেবে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর। এখানে বসবাসরত নাগরিকেরা বেশির ভাগ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শহরে চলাচলরত যানবাহনগুলোর গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৫-৬ কিলোমিটার। পৃথিবীর কোনো দেশের রাজধানী শহরে যানবাহনের এত নি¤œ গড় গতিবেগ নেই। আমাদের রাজধানী শহরে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক উভয় ধরনের যানবাহন চলাচল করে। কিছু কিছু সড়কে অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল বারিত হলেও যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা সড়কের আয়তনের তুলনায় অধিক হওয়ায় শহরের চতুর্মুখী মোড় অতিক্রম করতে হলে প্রতিটি মোড়ে এসব যানবাহনকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষমাণ থাকতে হয়। যেকোনো কর্মদিবসে ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অথবা কেন্দ্রস্থল থেকে বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্টেশন বা নৌবন্দরে যেতে হলে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এমনকি আবাসিক এলাকার মধ্যেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিদ্যালয়পর্যায়ের বিত্তবান পরিবারের শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে। আর এ কারণে বিদ্যালয়গুলো খোলা থাকলে বিভিন্ন সড়কে যানবাহনের অতিরিক্ত উপস্থিতিতে চলাচলে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটে।
আমাদের দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে সম্পন্ন করা হয় বিধায় যেকোনো ধরনের ছোট কাজ সম্পন্ন করার জন্যও একজন ব্যক্তির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উপরস্থ কর্মকর্তার দ্বারস্থ হতে হয়। বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দফতর বিভাগীয় শহরে স্থানান্তর করা হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্নের জন্য রাজধানীমুখী হওয়ার প্রবণতা আর দেখা দেবে না।
আমাদের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট ঢাকায় অবস্থিত। একসময় বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে হাইকোর্টের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হলে সাধারণ মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করেছিল। সরকারের এ পদক্ষেপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের রাজধানী শহরে আসার প্রবণতায় হ্রাস ঘটিয়েছিল; কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী আইনজীবীর অশুভ কারসাজিতে সরকারের এ জনমুখী কার্যক্রম বিফলতার কবলে পড়ে, যা মানুষের ভোগান্তি বৃদ্ধির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভিভিআইপি মর্যাদাধারী বিবেচনায় সড়কপথে রাজধানী শহরের অভ্যন্তরে চলাচলের সময় সব ধরনের যানবাহন চলাচল রোধ করা হয়। এতে যানজটের কবলে পতিত শহরটির যানজটের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। আর এর রেশ গভীর রাত অবধি অব্যাহত থাকে। রাজধানী শহরে বসবাসরত মানুষের চলাচল সহনীয় করতে হলে এ দুই পদধারীর চলাচল বিষয়ে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি আমাদের রাজধানী শহরের যানজট নিরসনে একাধিক সমন্বিত উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, এগুলো চালু হওয়া-পরবর্তী তা শহরটির যানজট সমস্যা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসবে; কিন্তু পরিকল্পনায় ত্রুটি থাকার কারণে এ উড়াল সেতুগুলো কাক্সিক্ষত প্রতিকার প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। যানবাহন বিশেষজ্ঞদের অভিমতÑ ব্যয়বহুল উড়াল সেতুর পরিবর্তে বিভিন্ন সড়কে ইউলুপ ও শহরের চতুর্মুখী মোড়গুলোতে ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হলে তা অধিক ফলপ্রসূ হতো।
আমাদের রাজধানী শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক। শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য ফেলার নির্ধারিত স্থান থাকলেও এগুলো উন্মুক্ত থাকার কারণে এবং প্রতিদিন ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বর্জ্য জমা হওয়ায় তা নির্ধারিত স্থান ছাড়িয়ে সড়কের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলার কারণে এর আশপাশের স্থান সব সময় দুর্গন্ধকবলিত থাকে। বর্জ্য পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত কাভার্ডভ্যান না থাকায় খোলা ট্রাকে দিনের বেলা বর্জ্য পরিবহন করতে দেখা যায়। খোলা ট্রাকে বর্জ্য পরিবহনের সময় অতিরিক্ত বর্জ্য বোঝাইয়ের কারণে ট্রাকটি চলার সময় সড়কের ওপর বর্জ্য ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি পড়ে মানুষের চলাচলে মারাত্মক অস্বস্তির সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে জৈব ও অজৈব বর্জ্য পৃথক করার যেমন ব্যবস্থা নেই, অনুরূপ জৈব বর্জ্য দিয়ে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনের পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে গৃহীত হয়নি এবং সরকারি উদ্যোগের অভাবে কোনো বেসরকারি সংস্থাও এগিয়ে আসেনি।

আমাদের বিভিন্ন নির্মাণস্থল থেকে খোলা ট্রাকে মাটি পরিবহনকালীন এগুলো সড়কের ওপর পড়ে সড়ককে কর্দমাক্ত ও ধুলায়িত করে। এ ব্যাপারে নগর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে শহরের যেকোনো সড়ক সংস্কার-পরবর্তী তা পুনঃসংস্কারের পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যায়।
আমাদের দেশে শহরের সড়কের পাশের নর্দমা ও পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় টানা দু-তিন ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই নর্দমা ও পয়ঃনিষ্কাশনের পথ উপচে চলাচলের সড়ক দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন ধরে নগরবাসী এ সমস্যাটির কারণে অস্বস্তির সম্মুখীন হলেও এটি নিরসনে কার্যকর ও ফলপ্রসূ উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

রাজধানী শহর ঢাকা বর্তমানে বিশ্বের বসবাস-অযোগ্য দশটি শহরের দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। যেসব উপসর্গের কারণে রাজধানী শহরের যানবাহনের গতিবেগ শ্লথ এবং বসবাস অসহনীয় তা নিরসন করা না হলে সে দিন আর খুব দূরে নয় যে, বিশ্বের বসবাস-অযোগ্য শহর হিসেবে আমাদের অবস্থান এক নম্বরে উন্নীত হবে, যা কোনোভাবেই দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশিত নয়। আর তাই রাজধানী শহর ঢাকাকে বসবাস-উপযোগী করতে হলে এখানে বসবাসরত মানুষের চলাফেরা যেন স্বস্তিদায়ক হয়, তার পথ সরকার পরিচালনার দায়িত্বে যারা রত তাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/283396