৯ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৭:৪৯

সামষ্টিক অর্থনীতির দুরবস্থা জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অভূতপূর্ব এক সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়েছে বলে জানা গেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস, কর্মসংস্থানের দুরবস্থা, জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান অচলাবস্থাও অব্যাহত গতিতে কর্মচ্যুত হয়ে প্রবাসী শ্রমিক-কর্মচারীদের দেশে প্রত্যাবর্তন, রেমিটেন্স প্রবাহে ছন্দপতন, বাণিজ্য ঘাটতি, ব্যাংকসমূহের পুঁজি ও তারল্য সংকট, রিজার্ভের পরিমাণ হ্রাস এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, জিডিপি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনিশ্চয়তা, মুদ্রা ও মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে জনদুর্ভোগ, খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি এবং স্থির ও নিম্নআয়ের মানুষের দুর্ভোগ, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট প্রভৃতি দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে বলে মনে হয়। পরিকল্পনা কমিশনের বরাত দিয়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের শীর্ষ মহলকে অবহিত করা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সামষ্টিক অর্থনীতির সংকটের বিষয়টি এখনো সুরাহা করার কোনও পথ খুঁজে পাননি। এদিকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের প্রবাহ সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। গত মওসুমে বন্যা ও প্লাবনের দরুন হাওর অঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহে বোরো ও আমন ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্য উৎপাদন সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। চলতি রবি মওসুমে গমের ফসলের হুইট ব্লাস্ট সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে সরকার বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়ার ছয়টি জেলায় গম চাষ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে মোটা চাল ৪০ টাকা এবং মাঝারী চাল কেজি প্রতি ৬০ টাকা অতিক্রম করেছে। ফলে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকার বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। প্রায় প্রত্যেক মাসেই পুরাতন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এই অনুমোদনের প্রাক্কালে অর্থের সংস্থান, জনবলের সংস্থান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সামর্থ্য, কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এবং জনচাহিদার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সরকার বিবেচনায় আনছেন না।
প্রায় দশ বছর আগে যখন এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল তখন ডলারের দাম ছিল ৬৯.০০ টাকা। বর্তমানে প্রতি মার্কিন ডলারের দাম হচ্ছে ৮৩.৫০ টাকা, কার্ব মার্কেটে এই মূল্য ৮৫.০০ টাকায়ও উঠে। অর্থাৎ ডলার প্রতি মূল্য বেড়েছে ১৬ টাকা।

এ বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী। প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশে ডলার পাচারের অভিযোগ এখন সর্বত্র। অর্থনীতির উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে আমদানি ব্যয় বাড়ছে, সিন্ডিকেটের উৎপাত তো আছেই। সরকারের একাধিক মন্ত্রী/এমপি বিভিন্ন জনসভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন এবং প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন যে, সিন্ডিকেটের জন্য তারা দ্রব্যমূল্য কমাতে পারছেন না। কথাটা যদি সত্য হয় তাহলে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? আবার অনেকে প্রশ্ন তুলে বলেছেন যে, এই সরকারের পক্ষে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভবপর নয়, কেননা তারা নিজেরাই সিন্ডিকেটের অংশ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সিন্ডিকেটের সুবিধাভোগী মানুষের এই ধারণা ভাঙার দায়িত্ব সরকারের।
আগেই বলেছি, বিদায়ী বছরসহ আওয়ামী শাসনের বিগত বছরসমূহে অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক ছিল নি¤œমুখী। বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থানে নিম্নমুখী প্রবণতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং মুদ্রাস্ফীতি স্থির আয়ের সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। দূরদর্শী নীতির অভাব এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও দুর্নীতি আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনাকে সমস্যা সংকুল করে তুলেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষার বার্ষিক পর্যালোচনায়ও এসব তথ্য উঠে এসেছে। উন্নয়ন অন্বেষার সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে এই প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে। কিন্তু এর সুফল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য দূরদর্শী কোনও নীতিমালা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কার্যকর কোনও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। গত কয়েক বছরে এক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে অনেক; দারিদ্র্য দূরীকরণের হার হ্রাস পেয়েছে সাংঘাতিকভাবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দারিদ্র্য বিমোচনের গড় হার হচ্ছে ১.৭০ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০১৬ এই পাঁচ বছরে দারিদ্র্য কমেছে ১.২০ শতাংশ হারে। একই সময়ে অতি দারিদ্র্য দূরীকরণের বার্ষিক গড় হার ১.৫ শতাংশ থেকে কমে ০.৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। ২০১০ সালে মোট জাতীয় আয়ের ১০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের অবদান ছিল ২ শতাংশ। কিন্তু ২০১৬ সালে এই অবদান কমে ১.০১ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে ২০১০ সালে দেশের ১০ শতাংশ ধনী পরিবারের জাতীয় আয়ে অবদান ছিল ৩৫.৮৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮.১৬ শতাংশে উন্নীত হয়। অর্থাৎ গরিব আরো গরিব হচ্ছে এবং ধনী আরো ধনী হচ্ছে। আওয়ামী শাসনের এই আমলে কর্মসংস্থান হ্রাস হচ্ছে জাতীয় উদ্বেগের আরেকটি বিষয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ছিল ৩.১ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই ৫ বছরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

গবেষণা সংস্থাটি তার রিপোর্টে আরো উল্লেখ করেছে যে, সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলেও বিগত বছরের মে মাস থেকে তা লাগামহীন হয়ে পড়ে এবং মূল্যস্ফীতি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। ২০১৭ সালের পুরো মেয়াদটাই বস্তুত: মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মেয়াদ, এই বছর খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৬.৮৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। এর প্রভাব নিম্ন আয়ের মানুষের উপর পড়েছে। ২০১০ সালে দেশে মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২৩১৮ কিলোক্যালরি।
২০১৬ সালে এর পরিমাণ ২২১০ কিলোক্যালরিতে এসে দাঁড়ায়। অতি দরিদ্র ৩৫ শতাংশ মানুষের ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ১৮০০ এর নিচে। রিপোর্ট অনুযায়ী অর্থনীতির আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, ব্যাপক অর্থ পাচারের ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। জিডিপি’র অনুপাতে সেরকারী বিনিয়োগ স্থবির অবস্থায় আছে। ২০১১-১২ থেকে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত বেসরকারী খাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ শতাংশেরও কম।

অন্যদিকে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার বাড়ছে। এই পাচারের পরিমাণ সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা। অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার যোগ্যতা ও সামর্থ্য সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানটি তার নিজের খবরই রাখতে পারে না, অন্য খবর তো দূরের কথা। জিডিপি’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে কৃষি, এই খাতের প্রবৃদ্ধির হারও কমেছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.৫ শতাংশ। এই হার ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০১৬-১৭ অর্থ-বছরে ৩.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে শিল্পখাত, রাজস্ব খাত এবং রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধিও যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির ফলে চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই অবস্থা আমাদের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত মারাত্মক।
বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। জনগণকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে এবং বাঞ্ছিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/314612