৮ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:৩৭

শিক্ষাভবনে দুর্নীতি অনিয়ম এখন ওপেন সিক্রেট

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রধান কার্যালয়ের ‘শিক্ষাভবন’ অনিয়ম দুর্নীতি বদলি বাণিজ্য পুরনো চেহারায় ফিসে এসেছে। ৩৫ হাজার সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাজের এ প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতির মহোত্সব। টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে বদলির অর্ডার। সংশ্লিষ্ট সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালকরা এ বাণিজ্যের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তা এ অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।

শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেবাদানের জন্য প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হলেও এখন চলছে উল্টো চিত্র। প্রতিষ্ঠানটির ঘুষ বাণিজ্য এখন নিয়মিত ব্যাপার। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক বদলিতে অবাধে চলছে ঘুষ ও তদ্বির বাণিজ্য।

গতকাল সরেজমিনে শিক্ষাভবনে শিক্ষক কর্মচারীদের নানা অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। ঢাকার বাইরে থেকে আসা এক অফিস সহকারী বলেন, আমি এ পদে ৪ বছর আছি। কিন্তু এখন আমাকে বদলি করে দেওয়া হবে শুনেছি। তাই যোগাযোগের জন্য অধিদপ্তরে এসেছিলাম। তৃতীয় তলায় এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিলেই নাকি সব ঠিক থাকবে। তাই এ বিষয়টি জানতে এসেছিলাম। আগামী সপ্তাহে টাকা পয়সা নিয়ে আসতে হবে বদলি ঠেকানোর জন্য।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল এক শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, তিনি বদলির জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা টাকা দাবি করেছেন। অনেকে বদলির অর্ডার পেলেও টাকা দিতে না পারায় আমার বদলি হয়নি। মাঠ পর্যায়ের অনেক শিক্ষা কর্মকর্তা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। মাঠ পর্যায় থেকে এ সব কর্মকর্তা প্রতিমাসে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে টাকা পাঠান। এ কারণে ৩ বছরের বেশি সময় একই স্থানে থাকা যাবে না এমন নির্দেশনা থাকলেও ৮ বছরেরও বেশি সময় একই উপজেলায় কর্মরত রয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা।

মাউশির হাতে গোনা ৪/৫ জন কর্মকর্তা এই অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের সাথে জড়িত রয়েছে্ন। ২০০৯ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে নানা অনিয়ম করার অভিযোগ পাওয়ার এক কর্মকর্তাকে সংস্থা থেকে সরিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু কিছুদিন অন্যত্র বদলি করা হলেও আবার তাকে শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার উপ-পরিচালক হিসাবে বদলি করে আনা হয়। দুজন মহাপরিচালক পরিবর্তন হয়েছেন কিন্তু তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে। পাঁচ বছরের বেশি সময় এই কর্মকর্তা উপ-পরিচালক হিসাবে থেকে ঘুষ বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। গতকাল এই কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, চাকরিতো আর খেতে পারবে না। সর্বোচ্চ বদলি করতে পারবে।

অর্ধশতাধিক বদলি নিয়ে বিতর্ক: গতকাল শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন মহাপরিচালক হিসাবে যোগ দিয়েছেন অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। এর আগে তিনি ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আগের মহাপরিচালকের চাকরির মেয়াদ শেষ হয় ৬ জানুয়ারি। কিন্তু ৬ জানুয়ারি শনিবার থাকায় বৃহস্পতিবার ৪ জানুয়ারি ছিল সাবেক মহাপরিচালকের শেষ কর্মদিবস।

শেষ কর্মদিবসে অধ্যাপক এসএম ওয়াহিদুজ্জামান তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক বদলি করেছেন ৭৭ জন। মাউশির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছন, এই বদলিতে অনিয়ম হয়েছে। হয়েছে অনৈতিক আর্থিক লেনদেন।

শেষ কর্মদিবসে বদলি করলেও ৭ তারিখের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়েছে। বদলি তালিকায় রয়েছেন ১৫ জন সহকারী শিক্ষক, ৮ জন শিক্ষা কর্মকর্তা, ২৯ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি, ২৫ জন সরকারি কলেজের প্রভাষক।

এর আগেও গত ২৭ ডিসেম্বর ১৯ জন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, ২৬ ডিসেম্বর ১৯ জন বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা, ২২ ডিসেম্বর ৬৪ জন কর্মচারী, ২১ ডিসেম্বর ১৯ জন বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা, ১৪ ডিসেম্বর ১৭ জন কর্মচারী, ৭ ডিসেম্বর চারজন কর্মকর্তাসহ আরো বেশকিছু বদলি করা হয়। অর্থাত্ মহাপরিচালকের শেষ কর্মমাসেও দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি করা হয়। যা অন্যান্য মাসের তুলনায় রেকর্ড বলে জানিয়েছেন মাউশি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

সাবেক দুই মহাপরিচালকের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, এটা রুটিন ওয়ার্ক। আর মহাপরিচালক চেয়েছেন তিনি বদলি করেছেন।

অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মোঃ আবদুল মান্নান বলেন, আমরা মহাপরিচালককে বলেছিলাম, তার শেষ দিনে যেন তিনি বদলির আদেশে স্বাক্ষর না করেন। এতে সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু এরপরও এত বদলি কিভাবে হলো তা বলতে পারবো না। তবে এটা একেবারেই শেষ সময়ে হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, মাউশির প্রশাসন শাখার কিছু কর্মকর্তা গত শনিবার সরকারি ছুটির দিনেও অফিস করেছেন। অনেক কর্মচারীর বদলির ফাইল গত বৃহস্পতিবারের তারিখ দিয়ে আসলে তা গত শনিবার স্বাক্ষর হয়েছে। তাই ওয়েবসাইটে গত বৃহস্পতিবারের আদেশ দেওয়া হয়নি। যা সম্পূর্ণই নিয়ম-নীতি বিরুদ্ধ কাজ বলে জানা গেছে।

 

http://www.ittefaq.com.bd/capital/2018/01/08/142598.html