৮ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:৩১

প্রত্যাবাসন প্রস্তুতির মধ্যেও রোহিঙ্গা আসা থামেনি

ঢল কমলেও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আসা এখনো পুরোপুরি থামেনি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কক্সবাজারে কর্মরত কর্মীদের মতে, ২০১৭ শেষ হয়ে ২০১৮ সাল এলেও রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা কমেনি। গত ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ৪০০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এ বছরও রোহিঙ্গারা আসছে। এখন যারা বাংলাদেশে ঢুকছে তারা অন্যদের চেয়ে বাড়তি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে। এ কারণে তাদের রাখাইন থেকে বের হতে দেরি হয়েছে।

কক্সবাজার থেকে আইওএম কর্মকর্তা ফিয়োনা ম্যাকগ্রেগর গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রত্যাবাসন উদ্যোগ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে পারেন না। কারণ আইওএম কোনো পক্ষ নয়। তবে তাঁরা নিশ্চিত যে রোহিঙ্গারা এখনো বাংলাদেশে আসছে।
ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাস থেকে ছয় লাখ ৫৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু করার লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এ অবস্থায় এখনো আশ্রয়ের খোঁজে রোহিঙ্গাদের রাখাইন ছেড়ে আসা সেখানকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। আগামী ১৫ জানুয়ারি নেপিডোতে প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক হবে। এরই মধ্যে মিয়ানমার দাবি করেছে, গত শুক্রবার রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) হামলা করেছে। অন্যদিকে আরসার কথিত বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মদদে চালানো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি। তাদের জোর করে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না।
এ বছরের শুরুতে ১৮ ও ২০ বছর বয়সী দুই মেয়ে এবং ১৫ বছরের এক ছেলেকে নিয়ে কক্সবাজারে পৌঁছাতে পেরেছেন রাখাইনের আহমেদ (৫০)। তিনি জানান, এক মাস আগে তাঁর দুই সন্তানকে জবাই করা হয়। যারা মাছ ধরতে গিয়েছিল, তারাও কেউ জীবিত ফেরেনি। এত কিছুর পরও তিনি এত দিন রাখাইন থেকে পালাতে পারেননি। কারণ তাঁদের গ্রামটিই ঘিরে রাখা হয়েছিল। তিনি আরো জানান, রাখাইনের রাথিডংয়ে তাঁর পরিবারের কয়েক সপ্তাহ কেটেছে অত্যন্ত ভয়ে। এমনকি চুলা জ্বালানোর জন্য কাঠ জোগাড় করতেও তাঁরা বাড়ির বাইরে যেতে পারেননি। তাঁদের হুমকি দিচ্ছিল প্রতিবেশীরা। পরে দেড় লাখ কিয়াত (প্রায় ৯ হাজার টাকা) ঘুষ নিয়ে তারাই পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে কক্সবাজারে আইওএমের মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক-সামাজিক সহায়তা সমন্বয়কারী ওগলা রেবোলেডো বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে আমরা প্রবল যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছি। তারা অত্যন্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে।’

গত ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশে ঢোকা ১৭টি রোহিঙ্গা পরিবারের ১০টিই অত্যন্ত অসহায় পরিস্থিতিতে আছে। তাদের বেশির ভাগই ‘সিঙ্গেল মাদার’, বিধবা বা প্রতিবন্ধী।
আসমা বেগম (৩৫) নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেছেন, রাখাইনের বুথিডংয়ে তাঁদের বাড়ির দুই পাশের বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাঁদের বাড়িটিই অক্ষত ছিল। গত আগস্ট মাসে হামলার আগেই তাঁর স্বামী মারা যান। কয়েক মাস আগে তাঁর ১৫ বছর বয়সী ছেলের ওপর প্রতিবেশীরা হামলা চালায়। এতে তাঁর ছেলের পা কেটে ফুলে যায় এবং সে হাঁটতে পারে না। এ কারণেই আসমা এত দিন রাখাইন ছেড়ে আসতে পারেননি।
আসমার বরাত দিয়ে আইওএম বলেছে, ছেলেকে নিয়ে অসহায়ভাবেই তিনি বাড়িতে পড়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশীরা বাড়িঘরে আগুন দেওয়া শুরু করলে পালানো ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় ছিল না। পালানোর সময় একজনকে তিনি টাকা দিয়েছিলেন তাঁর ছেলেকে পার করে দেওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে পৌঁছাতে পেরেছেন।

আইওএম জানায়, গত আগস্ট থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ছয় লাখ ২০ হাজারেরও বেশি জনকে তারা আশ্রয়সামগ্রী দিতে পেরেছে। তাদের মধ্যে ১৪ হাজার ৩৬১ জনের বাড়তি সহযোগিতা প্রয়োজন। এ ছাড়া তিন হাজার ৮৩০ জন রোহিঙ্গার মানসিক পরিচর্যা দরকার।
এক দিনে ১৩৭ রোহিঙ্গার প্রবেশ : কক্সবাজার থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গতকাল রবিবার টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ১৩৭ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এরা প্রবেশ করে। টেকনাফ উপজেলা সিনিয়র মত্স্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, তাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার পর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এর আগে গত শনিবারও শাহপরীর দ্বীপের ঘোলাচর পয়েন্ট দিয়ে ৫৪ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/01/08/587213