৮ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:২৯

দেড় হাজার পোশাক কারখানা বন্ধ

কমছে কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়

রানা প্লাজা ধসের পর নানা কারণে প্রায় দেড় হাজারের অধিক পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)। রপ্তানি আদেশ না পাওয়া, উৎপাদন ব্যয় বাড়াসহ নানা কারণে মালিকরাও নিজ থেকেই বন্ধ করে দিয়েছে অনেক কারখানা। ফলে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুরো খাত। সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন শ্রমিকরা। কর্মসংস্থান হারিয়ে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকে আবার পেশা বদল করেছেন।
অন্যদিকে বন্ধ কারখানাগুলো উৎপাদনে না থাকায় সামগ্রিকভাবে পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজিএমইএ ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, উৎপাদনে নেই দেড় হাজারেরও বেশি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা। এর মধ্যে কিছু কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কারখানায় নেই রপ্তানি আদেশ। কাজ না থাকায় এসব কারখানাও বন্ধ হওয়ার পথে। ফলে পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পেয়েছে। কারখানা বন্ধ হওয়ায় মালিক এবং শ্রমিক উভয়ই বিপদে পড়েছেন। অনেকেই এখন বেকার। এদের একটি অংশ ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে।
সূত্র জানায়, রানা প্লাজা ধসের পর বিভিন্ন সমস্যায় ৫৫০ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করে বিজিএমইএ। আর ব্যয় বাড়ায় প্রায় ৩০০ কারখানা নিজেরাই বন্ধ করে দেয় মালিক পক্ষ। অন্যদিকে নিয়মিত উৎপাদনে না থাকায় ১৮০ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করেছে বিকেএমইএ। আর প্রায় ২০০ কারখানা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা। ওদিকে সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতিতে ব্যর্থ হওয়ায় এ পর্যন্ত ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ২৩২ কারখানা। এসব কারখানার সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন ক্রেতারা। এ কারখানাগুলো দুই জোটের কোনো ক্রেতার রপ্তানি আদেশ পাচ্ছে না। কার্যত এসব কারখানা এখন বন্ধ।

বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, দেশের তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান দিন দিন কমে যাচ্ছে। গত দুই বছরে গার্মেন্ট সেক্টরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১৮ শতাংশ। আর প্রায় ১২০০ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। সেটিই এখন চ্যালেঞ্জে।
সরাসরি প্রতিটি কারখানা সরজমিন পরিদর্শনের পর প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিজিএমইএর কমপ্লায়েন্স সেল। সেই সূত্র মতে, বিজিএমইএর মোট সদস্য কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার ৩৩৯টি। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলের কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৬২৮টি। বাকিগুলো চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থিত। এসব কারখানার মধ্যে গত এক বছরে রপ্তানি আদেশের বিপরীতে ব্যবহৃত কাঁচমাল আমদানির অনুমতি বা ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) নিয়েছে ১ হাজার ৬১৮ কারখানা। মূলত এরাই সরাসরি উৎপাদন এবং রপ্তানি প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ইউডি না নিলেও ৮৭২ কারখানা সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে উৎপাদনে রয়েছে। বাকি কারখানাগুলো উৎপাদনে নেই।
উদ্যোক্তারা জানান, পোশাক খাতে নানামুখী চাপ তৈরি হয়েছে। তার প্রভাবেই কারখানা বন্ধ হচ্ছে। এর পাশাপাশি বাড়ছে উৎপাদন খরচ। কমছে পোশাকের দর। আর বিশ্ববাজারে কমছে পোশাকের চাহিদা। সব মিলিয়ে পোশাক খাতে সংকটে যাচ্ছে বলে তারা মনে করেন।

বিজিএমইএ মতে, গত কয়েক বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। একটি কারখানার পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ সময় প্রধান দুই বাজার ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে দর কমেছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ। আর বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে ৮ শতাংশ। এই তিন প্রতিকূলতায় গত অর্থবছরে পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ১৫ বছরের সর্বনিম্নে। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পোশাকের দর কমেছে ৪.৭১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে ৩.৩০ শতাংশ। চলতি বছরও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। বিশ্ববাজারে দর কমে আসার পাশাপাশি দেশে বেড়েই চলেছে উৎপাদন ব্যয়।
সূূত্র অনুযায়ী, নতুন মজুরি কাঠামোর জন্য ব্যয় বেড়েছে ৩২.৩৫ শতাংশ। গত বছর বিদ্যুৎ বাবদ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ এবং গ্যাসে বেড়েছে ৭.১৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৪০ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিংসহ (সিঅ্যান্ডএফ) পরিবহন খাতে।

শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে এর বেশিরভাগ শ্রমিক আইন অনুযায়ী তাদের বেতন-ভাতা পায়নি। ফলে অনেকেই কষ্টে জীবন-যাপন করছেন। এ ছাড়া যাদের চাকরি গেছে তাদের বেশিরভাগ বেকার রয়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে- চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে তৈরি পোশাক খাতের পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৭৭ কোটি ২৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার, যা এ সময়ের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২.৭৬ শতাংশ বেশি। আর গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে এবার এ খাতের পণ্য রপ্তানি আয় ৭.৭৫ শতাংশ বেড়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ২.৭৬ শতাংশ। এই ছয় মাসে নিট খাতে রপ্তানি বেড়েছে ১১.৪৭ শতাংশ। আর ওভেনে বেড়েছে ৪.০৪ শতাংশ।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে নিটওয়্যার পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৭৫৯ কোটি ৫২ লাখ ৭০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫.৫২ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭১৯ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার। একই সময়ে ওভেন গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৭১৭ কোটি ৭৫ লাখ ২০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ০.০২ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭১৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ২৯ শতাংশ, অগাস্টে রপ্তানি আয় বাড়ে ১০.৭১ শতাংশ। এই দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি হয় প্রায় ১৪ শতাংশ, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ বেশি। সেপ্টেম্বর শেষে সেই প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে নেমে আসে, লক্ষ্যমাত্রাও হোঁচট খায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক মাসে পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি সামান্য বাড়লেও গত ৩/৪ বছরের তুলনায় খুবই কম।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=99616