৮ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:২৬

ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা

ছয় পদ্ধতিতে কারসাজি

পরিচালন মুনাফা কোনো মুনাফাই নয়। এটা বছর শেষে যোগ-বিয়োগ করা। এ মুনাফা বেশি দেখাতে শুভঙ্করের ফাঁকির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে তদন্ত করা উচিত -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় কারসাজিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছয়টি পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ওই ছয়টির মধ্যে প্রধান দুটি হচ্ছে- বিপুল পরিমাণ খেলাপি এবং খেলাপিযোগ্য ঋণকে অখেলাপি দেখিয়ে ওই ঋণের ওপর আরোপিত সুদকে আয় খাতে দেখানো হচ্ছে, যা বিধান অনুযায়ী কোনোভাবেই দেখাতে পারে না। উভয় ক্ষেত্রেই কাগজ-কলমে মুনাফা দেখানো হয়। বাস্তবে সেখানে নগদ বা দৃশ্যমান কোনো অর্থ থাকে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, পরিচালন মুনাফা কোনো মুনাফাই নয়। এটা বছর শেষে যোগ-বিয়োগ করা। এরপর খেলাপির বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন ও আয়কর দেয়ার পর যা থাকবে তাই হল নিট মুনাফা। এছাড়া পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাতে শুভঙ্করের ফাঁকির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ রয়েছে বেশ কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে। সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদন্ত করা উচিত।

যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কারসাজির বাকি চারটি পদ্ধতির তৃতীয়টি হচ্ছে- স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে হয়। আর প্রভিশন রাখলে তা ব্যয়ের খাতায় যাবে কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক তা না করে আয়ের খাতায় দেখাচ্ছে। এ ধরনের কারসাজির কারণে সাময়িকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আয় বেড়ে যায়।
চতুর্থ পদ্ধতি হচ্ছে, অধিকাংশ ব্যাংক বছর শেষে কিছু খরচ বাকি রেখে হিসাব সম্পন্ন করে। বিশেষ করে দৈনিক ভিত্তিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ডিসেম্বরের পরিবর্তে পরবর্তী মাসে দেখানো হয়। আরও বেশ কিছু খরচ ডিসেম্বরে দেখানো হয় না। এতে পরিচালন মুনাফা বেড়ে যায়।
পঞ্চম : পুরো ব্যাংকিং খাতে অদাবিকৃত আমানত একদম কম নয়। দেখা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংকে অনেক অ্যাকাউন্ট আছে, যেখানে বছরের পর বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত থাকে। কিন্তু কোনো দাবিদার খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ধরনের অর্থের ১০ বছর পর্যন্ত কেউ দাবিদার না হলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক তা করে না। বরং উল্টো ওই আমানত থেকে প্রতি বছর কিছু কিছু অর্থ পরিচালন মুনাফায় দেখানো হয়। এতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়ে যায়।
আর ব্যাংক পরিচালন মুনাফায় কারসাজির সর্বশেষ (ষষ্ঠ) পদ্ধতি হচ্ছে, ব্যাংকগুলো সারা বছর যে পরিমাণ নতুন শাখা খোলে, তার ৮০ শতাংশ খোলা হয় ডিসেম্বরে। এ সময় বেশ কিছু অ্যাকাউন্টও খোলা হয়। এতে একটি অ্যাকাউন্ট পরিচালনায় বছরে যে পরিমাণ চার্জ কাটা হয়, সে পরিমাণ চার্জ রাখা হয় সদ্য খোলা অ্যাকাউন্ট থেকেও। এতে পরিচালন মুনাফা বেড়ে যায়। এর বাইরে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ তো রয়েছেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার হিসাবে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। পরিচালকদের চাপে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাংকারদের কর্মদক্ষতা দেখাতে ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে ব্যাংকাররা মুনাফা বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে অনেক ব্যাংকে মুনাফার হিসাবে ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়ে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বাড়তি মুনাফা বাদ দিতে বাধ্য করেছে। ফলে অনেক ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। একজন জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার যুগান্তরকে বলেন, ফারমার্স ব্যাংক মানুষের টাকা দিতে পারছে না। আবার বছর শেষে ব্যাংকটি ২৬ কোটি টাকা মুনাফা করল। বিষয়টি সাংঘর্ষিক। শুধু ফারমার্স একা নয়, প্রায় অর্ধেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় ভয়াবহ কারসাজি রয়েছে। এসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কাগজ-কলমে। যার কোনো বাস্তবতা নেই। প্রসঙ্গত, বিদায়ী বছরে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটেছে। প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেরই আগের বছরের চেয়ে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।

জানা গেছে, বছরের শেষ দিনে ব্যাংকগুলো তাদের সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব করে থাকে। বের করে তাদের পরিচালন মুনাফা। তবে এ মুনাফা একেবারেই প্রাথমিক হিসাব। প্রকৃত মুনাফা আরও কম হবে। যথাযথভাবে খেলাপি ঋণের হিসাব করা হলে এবং এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হলে এটি তিন ভাগের এক ভাগও থাকবে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের ইমেজ ঠিক রাখতে এমডি-পরিচালকরা মিলেমিশে পরিচালন মুনাফা বাড়িয়ে থাকেন। এটা কিছুতে ঠিক নয়। বরং অনৈতিক। প্রকৃত হিসাব লুকিয়ে এভাবে পরিচালন মুনাফা দেখানো উচিত নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি আরও বাড়ানো দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ব্যাংকগুলো ২১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা দেখায়। কিন্তু প্রকৃত মুনাফার পরিমাণ দেখা যায় মাত্র ৭ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সালে প্রথমে দেখানো ২৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটিতে নামে প্রকৃত মুনাফা। এই মুনাফা থেকেই শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয় ব্যাংকগুলো। ফলে নতুন বছরের শুরুতে ব্যাংকগুলো যে উচ্চ মুনাফা ঘোষণা করে, সে অনুপাতে লভ্যাংশ দিতে পারে না। এতে আশাহত হন বিনিয়োগকারীরা। সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের দায় মেটাতে। জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেগুলো আদায় হচ্ছে না। ফলে এগুলো খেলাপিতে পরিণত হয়ে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা খেয়ে ফেলছে প্রভিশন। এছাড়া ঘোষণা ছাড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের চার্জ আদায় করে মুনাফার অঙ্ক বাড়াচ্ছে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তদন্তে ধরা পড়ার পর এগুলো ফেরত দেয়ার নজিরও রয়েছে।

সূত্র জানায়, বছরের শুরুতে পরিচালকরা ব্যাংক নির্বাহীদের বিভিন্ন খাতে ব্যবসার একটি লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেন। এটি অর্জন করতে না পারলে পদোন্নতি আটকে যায়, প্রফিট বোনাস কম পাওয়া যায়। এসব কারণে ব্যাংকাররা পরিচালকদের চাপে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মুনাফার অঙ্ক বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন।
দেশে সরকারি মালিকানাধীন তফসিলি ব্যাংক রয়েছে আটটি। আর বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৯টি। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংক রয়েছে ৩৯টি। আর এ ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ার রয়েছে সাধারণ মানুষের হাতে। এ কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মুনাফা জানার আগ্রহ থাকে জনসাধারণের। কিন্তু পরিচালন মুনাফায় যা দেখানো হয়, তাতে বরাবরই ঠকছেন শেয়ারহোল্ডাররা- মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/4203