গতকাল রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি বাতিল এবং মূল্য কমানোর দাবিতে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়
৮ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:৫৭

বিদ্যুতের বাড়তি দামে গ্রাহকের ব্যয় বেড়েছে ১৩ হাজার ২২ কোটি টাকা

ডিসেম্বরের বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বাড়তি দামে বিদ্যুৎ বিল গুণতে হচ্ছে। নবেম্বরে ইউনিট প্রতি ৩৫ দশমিক ৫ পয়সা বাড়নোর পর ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। এবং চলতি মাস থেকে গ্রাহকদের দিতে হচ্ছে বাড়তি বিল। ক্যাব বলছে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে বাড়তি ব্যয় বেড়েছে ১৩ হাজার ২ কোটি টাকা। দাম না কমালে তারা বিইআরসির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার কথা জানিয়েছে।
গণশুনানিতে আসা যৌক্তিক সুপারিশ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গ্রাহক পর্যায়ে আরোপিত বিদ্যুতের বাড়তি দাম ১০ দিনের মধ্যে প্রত্যাহার না করলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছে ভোক্তা অধিকার রক্ষা সংগঠন ক্যাব।

গতকাল রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই হুমকির পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে ‘অন্যায় ও অযৌক্তিক’ ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুতের দর সম্বয়ের দাবি জানায় কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বিআরইসি যে মূল্য নির্ধারণ করেছে তা আমাদের দৃষ্টিতে আইনসম্মত হয়নি এবং অযৌক্তিক। যদি তাদের কাছে প্রতিকার না পাই তাহলে আইনগত ব্যবস্থা না নেয়া ছাড়া আমাদের কোনো গতি থাকবে না। সরকার ও বিইআরসির কাছে আমাদের আবেদন, অবিলম্বে মূল্যবৃদ্ধির আদেশ বাতিল করা হোক। একইসাথে ক্যাবের প্রস্তাব অনুযায়ী, মূল্য হ্রাস করা হোক। ৮-১০ দিনের মধ্যে যদি কোনো ব্যবস্থা সরকার না করে তাহলে আমরা ভোক্তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনানুগ প্রক্রিয়া গ্রহণ করব।
গত ২৩ নবেম্বর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।

ক্যাব বলছে, বিইআরসির গণশুনানিতে তারা দাম কমানো যে সম্ভব, তা যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিল। ফলে এখন দাম বাড়ানোয় গণশুনানি ‘অর্থহীন’ বলে প্রমাণিত হল। নয় বছর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর এ পর্যন্ত আট বার বাড়ানো হল বিদ্যুতের দাম।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিইআরসির জারি করা আদেশে ‘অন্যায় ও অযৌক্তিক’ কারণ দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম।
সম্মেলনে বিদ্যুতের দাম কমাতে ১৫ দফা সুপারিশ ও বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভোক্তাস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম অনুসন্ধানের জন্য ভোক্তা প্রতিনিধি নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের দাবি তুলে ক্যাবের ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন ও বিতরণে ঘাটতি যৌক্তিক গণ্য করে বিআরইসি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে। একি প্রহসন, নাকি প্রতারণা- এর বিচার চায় জনগণ। বিদ্যুতে মোট অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে ১৩ হাজার ২২ কোটি টাকা। ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণে এই অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধির পুরোটাই বহন করে ভোক্তারা।
বিআরইসি ইচ্ছেমতো-যা খুশি তা করতে পারে না মন্তব্য করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ার গোলাম রহমান বলেন, বিইআরসি ভোক্তা ও উৎপাদকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সমন্বয় করবে। তাদের একটি রেগুলেশন আছে- কীভাবে মূল্য নির্ধারিত হবে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে গণশুনাতিতে ভোক্তাদের যুক্তি-তর্ক, তথ্য প্রমাণ উপেক্ষিত হয়েছে।

গত বছর আবাসিক খাতসহ বিভিন্ন শ্রেণিতে ৫ থেকে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে কৃষি, ক্ষুদ্রশিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের দামও। শেষে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি তিন টাকা ৮২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে চার টাকা করা হয়েছে। ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুতের দাম অফপিক ছয় টাকা ৯০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে সাত টাকা ৩৮ পয়সা, পিক সময়ে নয় টাকা ২৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে নয় টাকা ৮৪ পয়সা করা হয়েছে। আর ফ্ল্যাট রেটের ক্ষেত্রে সাত টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে আট টাকা ২০ পয়সা করা হয়েছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আগের ফ্ল্যাট রেট নয় টাকা ৮০ পয়সার স্থলে করা হয়েছে ১০ টাকা ৩০ পয়সা, অফপিক সময়ের আট টাকা ৪৫ পয়সার স্থলে নয় টাকা ২৭ পয়সা এবং পিক সময়ের জন্য ১১ টাকা ৯৮ পয়সার স্থলে ১২ টাকা ৩৬ পয়সা দর নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া মধ্যচাপ শ্রেণির, অর্থাৎ ৫০ কিলোওয়াট থেকে ৫ মেগাওয়াট, উচ্চচাপ ৫ থেকে ৩০ মেগাওয়াট এবং অতি উচ্চচাপ ২০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ মেগাওয়াট ব্যবহারকারীদের জন্যও দর পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় এক দফা পণ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। সামনে এলএনজি আসছে। তখনও আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। তাই এ সময়ে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোই যৌক্তিক ছিল। কিন্তু দাম বাড়ানোর ফলে ডিসেম্বর থেকে বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। এতে করে ব্যবসায়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ভারতের পোশাক খাতে তাদের সরকার নানা ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। দেশটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে এ বছর দুই দফা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো, যা পণ্যের উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দেবে। ব্যবসায়ীর প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, এর ফলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবন-ব্যয় বাড়বে। বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা মুদ্রাস্ফীতিও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সিএনজি ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে তাদের প্রফিট মার্জিন কমে যাচ্ছে।
দাম বাড়নোর পর কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের জন্য এনার্জি কস্ট ও বিতরণ ব্যয় বিবেচনা করা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্রাহকের আঙিনায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে গড়ে ছয় টাকা ৮৪ পয়সা পর্যন্ত খরচ করে। কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রতি ইউনিটে এখন ছয় টাকা ৫০ পয়সা রাজস্ব আদায় করছে। এতে তাদের প্রতি ইউনিটে ৩৫ পয়সা লোকসান হচ্ছে। কমিশন এবার এই ৩৫ পয়সাই বৃদ্ধি করেছে।

http://www.dailysangram.com/post/314386