৮ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:৪৩

মার্কিন প্রেসিডেন্টের জয়-পরাজয়

আশিকুল হামিদ : এমন একটি বিশেষ প্রচারণা সম্প্রতি জোরদার হয়ে উঠেছে যে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তির পরিবর্তে যুদ্ধকে অনিবার্য করতে চাচ্ছে। একথাও বলা হচ্ছে, সত্যি শুরু হয়ে গেলে সে যুদ্ধ কোনো বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং পরিণত হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বিনাকারণে অমন আশংকা প্রকাশ করছেন না। বিগত মাত্র কয়েকদিনের কথাই স্মরণ করা যাক। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন পরিষ্কার হুমকি দিয়ে বলেছেন, পারমাণবিক বোমার চাবি তার নিজের টেবিলের ওপর থাকে। এখনো রয়েছে। বড় কথা, ওই সব বোমা পুরো যুক্তরাষ্ট্রকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও দেরি করেননি। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে বলেছেন, তার টেবিলে কিম জং উনের চাইতে অনেক বড় এবং কয়েকটি বোতাম রয়েছে। আর তিনি যদি সে বোতামগুলো টেপেন তাহলে উত্তর কোরিয়া মাটিতে মিশে যাবে!

এভাবেই উত্তর কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদ্বয় বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় তুলেছেন। এই আলোচনা কিন্তু এক সময়ের রেসলার বা কুস্তিগীর ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই চলে আসছে। এমন একটি প্রচারণাও রয়েছে, যার মূলকথা হলো, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুধু তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই বাঁধাবেন না, বিশ্বযুদ্ধ না বাঁধিয়ে তিনি ছাড়বেনই না। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলেই বিশ্ববাসীকে আরো একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ দেখতে এবং সে যুদ্ধের অসহায় শিকারে পরিণত হতে হবে। অত্যন্ত ভীতিকর সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট দেখিয়ে এসেছেন। কিম জন উনকে হুমকি দেয়ার আড়ালে এখনো দেখিয়ে চলেছেন।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তার সমস্যার কথাই ধরা যাক। কমিউনিস্ট এ দেশটির সঙ্গে বেশ কয়েক মাস ধরে কথার যুদ্ধে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। মাঝখানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়েও পৌঁছেছে যখন মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ, একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে উত্তর কোরিয়া প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের কঠোর বিরোধিতা করে এসেছে। এই বিরোধিতার সূচনা করে গেছেন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা নেতা এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের দাদা বা পিতামহ কিম ইল সুং। কিম জং উনও দাদার উপযুক্ত নাতির ভূমিকা পালন করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে সে সম্পর্কে সব জেনে-বুঝেই তিনি একের পর এক উসকানি দিয়ে এসেছেন। সর্বশেষ সংকটের সময়ও তাকে যথেষ্ট উদ্ধতই দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট কিম জং উন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এমনকি ‘অথর্ব বৃদ্ধ’ বলে ব্যঙ্গ-তামাশা করতেও ছাড়েননি। ভাবখানা এমন ছিল যেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাইলে তার সঙ্গে কুস্তিও করতে রাজি আছেন তিনি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিন্তু ঠিক পাহলোয়ান সুলভ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি। তাকে বরং সময়ে সময়ে পিছিয়ে যেতে বা পশ্চাদপসারণ করতেও দেখা গেছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, উত্তর কোরিয়ার তথা প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের এত সাহস ও শক্তির উৎস কোথায়? সংক্ষেপে উত্তর হলো, একদিকে দেশটির নিজের রয়েছে পারমাণবিক সমরাস্ত্র, অন্যদিকে পাশেই আছে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি গণচীন। রাশিয়ার সঙ্গেও দেশটির সম্পর্ক যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ। তাছাড়া উত্তর কোরিয়ার জনগণও প্রবলভাবে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী। সেভাবেই জনগণকে তৈরি করা হয়েছে। তারা বিশ্বাস করে, যেহেতু অর্থনীতির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দুই মিত্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় দরিদ্র সেহেতু যুদ্ধ বাঁধলে বা আক্রান্ত হলেও তাদের হারানোর কিছু নেই। অন্যদিকে তাদের নেতা কিম জং উন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর আক্রমণ চালানোর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখেন। একই কারণে উত্তর কোরিয়া যেমন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকিকে পরোয়া করেনি বরং সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে, অন্যদিকে মুখে হুমকি উচ্চারণ করলেও ট্রাম্পের পক্ষে অন্তত পিয়ং ইয়ং-এর বিরুদ্ধে হামলা চালানো এবং যুদ্ধ শুরু করা সম্ভব হয়নি। দু’ দেশের সম্পর্ক অবশ্য এখনো উত্তেজনাপূর্ণ রয়েছে। দু’-চারদিন পরপর দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসহ নতুন নতুন পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা করার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কিম জং উন জানান দিয়ে চলেছেন, তার দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে পরোয়া করে না। বিশেষ করে ‘বৃদ্ধ ও অথর্ব’ হিসেবে বর্ণিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকিতে উত্তর কোরিয়া মোটেও ভীত বা উদ্বিগ্ন নয়। আক্রান্ত হলে দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন প্রেসিডেন্ট কিম জং উন। সে ঘোষণার অংশ হিসেবেই তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের বোতাম সম্পর্কে জানান দিয়েছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য এ ধরনের ঘোষণা ও হুমকিতে পিছিয়ে যাওয়ার মতো লোক নন। তা সত্ত্বেও তিনি যখন হুমকি উচ্চারণের বাইরে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নেননি, তখনই বিশ্বের দেশে দেশে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলতে শুরু করেছিলেন, বিশ্বকে অশান্ত করে তোলার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের সম্ভবত দ্বিতীয় কোনো পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৭ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে এসে সত্যিই তেমন অন্তত একটি পরিকল্পনা সম্পর্কে জানান দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আশু কোনো কারণ বা উপলক্ষ ছাড়াই আকস্মিক এক বিবৃতিতে তিনি পূর্ব জেরুজালেমকে অবৈধ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের রাজধানী বলে ঘোষণা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্যালেস্টাইনসহ মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও আসলে সেটাই চেয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়াকে ‘দেখে’ আসার পর মুসলিম বিশ্বকে ‘দেখা’ এবং ‘এক হাত নেয়া’ তার দরকার ছিল।
কিন্তু এ ব্যাপারেও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিরাশই হতে হয়েছে। তিনি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ‘হাতের পুতুল’ এবং ‘হাতিয়ার’ হিসেবে পরিচিত জাতিসংঘেও সফল হতে পারেননি। পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে ওয়াশিংটনের তথা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের লজ্জাকর পরাজয় ঘটেছে। এই ভোটাভুটির আয়োজন করা হয়েছিল তুরস্ক ও ইয়েমেনের উত্থাপিত প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে। ভোটাভুটির ঠিক প্রাক্কালে আন্তর্জাতিক কূটনীতির সকল রীতি ও সৌজন্যের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, কোন কোন রাষ্ট্র তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দেয় তা তিনি ‘দেখে’ ছাড়বেন। এটা ছিল এক নির্লজ্জ ও ন্যক্কারজনক হুমকি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তুরস্ক ও ইয়েমেনের উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষেই ভোট দিয়েছে ১২৮টি রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ভোট পেয়েছে মাত্র নয়টি। তাছাড়া এমন ৩৫টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থেকেছে যারা সাধারণত এ ধরনের বিতর্কে জড়াতে চায় না। বলা হচ্ছে, বিরত থাকার মাধ্যমে ওই রাষ্ট্রগুলোও প্রকৃতপক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ ১৬৩টি রাষ্ট্রের সমর্থন অর্জন করতে পারেননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

ওদিকে মুসলিম বিশ্বে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্ব জেরুজালেম সংক্রান্ত ঘোষণা প্রবল প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়ে ওআইসি পূর্ব জেরুজালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছে। ওআইসি’র বর্তমান চেয়ারম্যান এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগানের আহ্বানে দেশটির বৃহত্তম নগরী ইস্তাম্বুলে গত ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের বিশেষ সম্মেলনে গৃহীত এক ঘোষণায় ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং পূর্ব জেরুজালেমকে এর রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্বের সকল দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্টের পূর্ব জেরুজালেম সংক্রান্ত ঘোষণার প্রতিবাদ জানানোর এবং মুসলিম বিশ্বের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্যেই প্রেসিডেন্ট এরদোগান ওআইসির এই বিশেষ শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীসহ ওআইসির সকল সদস্য রাষ্ট্রের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান এবং প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন।
সম্মেলনের ঘোষণায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে আইনগতভাবে অবৈধ বলে মন্তব্য করে বলা হয়েছে, এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে, চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং নতুন করে ছড়িয়ে পড়বে প্রাণঘাতী সংঘাত। আর এ ধরনের সকল প্রতিক্রিয়ার জন্যই দায়ী থাকবেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পথ ধরে কোনো দেশ যদি পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তাহলে মুসলিম দেশগুলো সম্পর্ক ছিন্ন করাসহ তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে বলেও ঘোষণায় সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। ওআইসি একই সঙ্গে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডের ওপর থেকে ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে তৎপর হওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
ওআইসির ইস্তাম্বুল শীর্ষ সম্মেলনে দেয়া ভাষণে ইসরাইলকে একটি ‘অবৈধ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, দেশটির ইহুদী সরকার ক্রমাগত ফিলিস্তিনের ভূখন্ড দখল করে চলেছে। ইসরাইলের এই সম্প্রসারণবাদী তৎপরতাকে কোনোক্রমেই গ্রহণ করা হবে না বরং প্রতিহত করতে হবে। জেরুজালেম তথা বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব মানবতাকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। এই ভুল, বেআইনি ও উসকানিমূলক সিদ্ধান্তের পেছনে খ্রিস্টান ও ইহুদিবাদী মন-মানসিকতা কাজ করেছে বলে কটাক্ষ করে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সিদ্ধান্তটি বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সংঘাতে মধ্যস্থতা করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান আরো বলেছেন, যেসব দেশ আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারকে মূল্যায়ন ও সম্মান করে সেসব দেশের উচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করা এবং জেরুজালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া।

ওআইসির বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী বলেছেন, ওআইসির পক্ষ থেকে পূর্ব জেরুজালেম তথা আল-কুদ্সকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তার বাস্তবায়নে মুসলিম দেশগুলোকে কঠোর অবস্থান নিয়ে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট রুহানী বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, মুসলিম দেশগুলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলে মার্কিন সরকার তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবে না। গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করে ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বিশ্বের সব দেশের মুসলিমরাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মুসলিম ও ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বুঝতে পেরেছে এবং এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। ইস্তাম্বুল ঘোষণাও তার প্রমাণ।
ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ওআইসির বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ ছাড়াও ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থে বক্তব্য যেমন রাখা হয়েছে তেমনি নেয়া হয়েছে কিছু সিদ্ধান্তও। পূর্ব জেরুজালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করে ওআইসির দেয়া ঘোষণার প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছে মুসলিম বিশ্বের সকল রাষ্ট্র। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বিশ্বের প্রায় সকল দেশও যে যোগ দিয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে জাতিসংঘের ভোটাভুটিতেÑ যেখানে ১২৮টি সদস্যরাষ্ট্র সরাসরি ভোট দিয়ে এবং ৩৫টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। দেশগুলো প্রকৃতপক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেয়া সিদ্ধান্তেরই বিরোধিতা করেছে।

বলা দরকার, ওআইসির সিদ্ধান্ত ও ঘোষণার এবং জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটির পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। কারণ, ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল অবৈধ পন্থায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত ফিলিস্তিনের ভূখন্ড দখল করে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকালেই ইহুদি সমরবাদীরা জেরুজালেমের পশ্চিম অংশ দখল করে নিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ পাশ্চাত্যের মুসলিম বিরোধী দেশগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতায় শক্তিশালী হয়ে ওঠা ইসরাইল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেমও দখল করে নেয়। ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নেতারা একই সঙ্গে ঘোষণা করেন, মুসলিমদের পবিত্র স্থান বায়তুল মুকাদ্দাস তথা পূর্ব জেরুজালেমই হবে ইসরাইলের রাজধানী।
কিন্তু ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রতিরোধের পাশাপাশি সকল আরব রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাপি মুসলিমদের তীব্র বিরোধিতার কারণে এতদিন ইসরাইল তার সে ঘোষণার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অন্যদিকে পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু ইসরাইলের সমর্থনেই অবস্থান নেননি, পরিষ্কার উসকানিও দিয়েছেন। এর ফলে ইসরাইল যেমন উৎসাহিত হবে, তেমনি প্রতিরোধ গড়ে তুলবে ফিলিস্তিনিরা। তারা যে সঙ্গিহীন বা দুর্বল নয় বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বই যে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াবে- সে ঘোষণাই এসেছে ওআইসির ইস্তাম্বুল শীর্ষ সম্মেলন থেকে। জাতিসংঘেও এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকা অন্য সকল দেশও ইসরাইলের অন্যায় যুদ্ধ ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। একাত্মতা প্রকাশ করেছে ওআইসির ঘোষণার সঙ্গে।
তাই বলে খুব বেশি আশাবাদী হয়ে ওঠা অবশ্য উচিত নয়। কারণ, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওআইসির আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার সিদ্ধান্ত বাতিল করেননি, বরং জাতিসংঘে ভোটাভুটির আয়োজন করিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই অবস্থান প্রকারান্তরে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধ বাঁধানোর পথে পা বাড়িয়েছেন। ওদিকে অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যা। সব মিলিয়েই মনে করা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তির পরিবর্তে যুদ্ধকেই অনিবার্য করতে চাচ্ছে। সত্যি শুরু হয়ে গেলে সে যুদ্ধ কোনো বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং পরিণত হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে। অমন আশংকাই করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষরকরা। এখন দেখার বিষয়, একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়া এবং মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পথে ডোনাল্ড ট্রাম্প সত্যি এগিয়ে যাওয়ার ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নেবেন কি না। কারণ, তেমন ক্ষেত্রে চীন তো বটেই, এমনকি রাশিয়াও জড়িয়ে যাবে। ভারতের পক্ষেও নীরবে বসে থাকা সম্ভব হবে না। ওদিকে পাকিস্তানের প্রধান নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ মাত্র দিন কয়েক আগেই ঘোষণা করেছেন, তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কোনো সিদ্ধান্তকে ‘পরোয়া’ করেন না। কথাটার মর্মার্থ নিশ্চয়ই বোঝেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

http://www.dailysangram.com/post/314430