৭ জানুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ১০:৫৯

বিমানের গচ্চা ৮৩৭ কোটি টাকা

মার্চ ও মে মাসে ফেরত যাবে এয়ারক্রাফট * চুক্তির সব শর্ত ছিল ইজিপ্ট এয়ারের পক্ষে -সংসদীয় কমিটি


ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর’র পেছনে বাংলাদেশ বিমানের গচ্চা ৮৩৭ কোটি টাকা। ত্রুটিপূর্ণ চুক্তির কারণে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটিকে বড় অঙ্কের এ অর্থ গুনতে হচ্ছে। টাকার জোগান দিতে বিমান এরই মধ্যে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর কাছে লোনের জন্য আবেদন করেছে। এদিকে বছরের বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকায় চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এয়ার ক্রাফট দুটি ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি আগামী মার্চ এবং দ্বিতীয়টি মে মাসে ফেরত পাঠাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। গত চার বছরের বিভিন্ন সময়ে এ দুটি উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট চালিয়ে বিমানের কোনো লাভ হয়নি। সংসদীয় কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তির সব শর্তই ইজিপ্ট এয়ারের পক্ষে।
বিমানের জেনারেল ম্যানেজার শাকিল মেরাজ বলেন, পাঁচ বছরের চুক্তিতে আনা উড়োজাহাজ দুটির মেয়াদ ছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। কিন্তু অব্যাহত লোকসান আর বছরের বেশির ভাগ সময় নষ্ট হয়ে পড়ে থাকায় বোয়িং দুটি ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

শাকিল মেরাজ বলেন, ভাড়ায় আনা একটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর নয় মাস বসে থাকার পর গত আগস্টে সচল হয়। কিন্তু সেবা সন্তোষজনক না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দুটি বিমান ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য বিমান দেড় লাখ মার্কিন ডলার ব্যয়ে একটি বিদেশি কনসালটেন্ট ফার্ম নিয়োগ দেয়। তারা বিমান ও ইজিপ্ট এয়ারের সঙ্গে দেনদরবার করে প্রাথমিকভাবে ৮৩৭ কোটি টাকায় রফা করে। যদিও ফার্মটি এখনও তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কনসালটেন্ট ফার্মের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এই টাকায়ও ইজিপ্ট এয়ার মানতে চাচ্ছে না। যদি সেরকম কিছু হয় তবে টাকার অঙ্ক আরও বাড়তে পারে। প্রতিটি এয়ারক্রাফট মাসে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা করে ভাড়ায় আনা হয়। এত টাকায় আনা উড়োজাহাজ বসে থাকায় বিমানের বোঝায় পরিণত হয়।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশিষ রায় চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বিমানের উচিত ছিল এই দরকষাকষির সঙ্গে বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্ল্যানিং বিভাগের কর্মকর্তা কিংবা বুয়েট বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া। যাদের জবাবদিহিতা থাকবে। বিদেশি কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না। তারা অনিয়মও করতে পারে, যা বাংলাদেশ বিমানের পক্ষে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভুল আর পক্ষপাতদুষ্ট চুক্তির কারণে গত তিন বছর ধরে দুটি এয়ারক্রাফট নষ্ট হয়ে পড়ে থাকলেও ফেরত দেয়া সম্ভব হয়নি। বসিয়ে রেখে ভাড়া দিতে হয়েছে।বিকল ইঞ্জিন পুনঃস্থাপন করতে হয়েছে। চুক্তির কারণে ফেরত দেয়ার সময় আগের অবস্থায় দিতে হবে। অর্থাৎ সেখানে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে। তারা বলেন, কর্মকর্তাদের অদক্ষতার নজির হচ্ছে এই চুক্তি। যার খেসারত হিসেবে বিমানকে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।

জানা গেছে, ইজিপ্ট এয়ার থেকে ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজ দুটির মধ্যে একটি বিমান বহরে যুক্ত হয় ২০১৪ সালের মার্চে, অপরটি মে মাসে। এক বছর ফ্লাইট পরিচালনার পর এর একটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়া আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয় বাকি ইঞ্জিনটিও। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে আবারও নতুন ইঞ্জিন আনা হয় ভাড়ায়। কিন্তু ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সেই ভাড়ায় আনা ইঞ্জিনও বিকল হয়ে যায়। পরে ইঞ্জিন মেরামত করতে যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হয় বিমানকে। রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমানকে সব ব্যয় বহন করতে হয়েছে।
এয়ারক্রাফট দুটি ভাড়ায় আনার পর থেকে চারটি ইঞ্জিন নষ্ট হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো বিমানের মেরামত করে দেয়ার কথা। সে হিসেবে চারটি ইঞ্জিন ক্রয় ও মেরামত বাবদ এ পর্যন্ত বিমানের ব্যয় হয়েছে ৪০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩২১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ ছাড়া উড়োজাহাজ দুটির মাসিক ভাড়া বাবদ বিমানকে প্রতি মাসে ১.১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হবে। এতে চার বছরে দুটি এয়ারক্রাফটের জন্য ৪৬৬ কোটি ১২ লাখ টাকা দিতে হবে। অপর দিকে চুক্তি অনুযায়ী উড়োজাহাজ দুটি ইজিপ্ট এয়ারকে ফেরত দেয়ার সময় আগের অবস্থায় করে দিতে হবে। এজন্য খরচ বহন করবে বিমান। ভাড়া নেয়ার পর বিমান উড়োজাহাজ দুটি রং পরিবর্তন করে বিমানের লোগো স্থাপন করে। ভেতরেও রং পরিবর্তন করে। সিটের সংখ্যা বাড়ায়। আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হলে কনসালটেন্ট ফার্মের হিসাব অনুযায়ী বিমানকে দুটি এয়ারক্রাফটের জন্য ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ৮৩৭ কোটি টাকা।

অনিয়মের খবর পেয়ে গত জুনে তদন্ত কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কামরুল আশরাফ খানের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জুলাই মাসে ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উড়োজাহাজ দুটি লিজ চুক্তির সব শর্তই ছিল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। লিজ এবং মেরামতের ক্ষেত্রে ‘চরম অবহেলা ও অনিয়ম’ ঘটেছে। বিমান মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে ‘চরম উদাসীনতা’ দেখিয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে ‘অপ্রচলিত ব্যয়বহুল’ এ লিজকে বিমানের স্বার্থবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দেয়ার সুপারিশ করে কমিটি। এতে বলা হয়, লিজ নেয়ার সময় ইঞ্জিনের সক্ষমতা যাচাইয়ে ব্যর্থতা এবং ‘অপ্রচলিত ব্যয়বহুল এই লিজ’ বিমানের স্বার্থবিরোধী।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/3800