৭ জানুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ৯:৩৯

গণতন্ত্র না থাকায় নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে

গণতন্ত্রহীনতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও বিনিয়োগ খরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সরকার ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও উল্টো বেকারত্ব বেড়েছে। গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশের রফতানি খাত। দেশে কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাশীনদের দখলে চলে যাচ্ছে। গতিহীন অর্থনীতি এ বছর পড়বে নির্বাচনী চাপে। ফলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কারণে নতুন বছরে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। তবে কার্যকর বাজেট তৈরি করতে পারলেই এসব সংকট কাটিয়ে উঠা সম্বব হবে।

নতুন বছর মানেই নতুন চ্যালেঞ্জ। যদি সেটি হয় নির্বাচনী বছর, তা হলে তো কথাই নেই। অন্য চ্যালেঞ্জের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয় ভোটারদের মন জয়ের তৎপরতা ও সরকারের তরফে নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার চ্যালেঞ্জ। এসবের নেপথ্যে থাকে অর্থ। নির্বাচন ঘিরে উড়ে বেড়ায় অর্থ। ফলে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ মাত্রাতিরিক্তি বেড়ে যায়। অন্যদিকে নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি থাকায় নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের নীতি কেমন হবে, তা পর্যবেক্ষণ করায় ব্যবসা বাড়ানোর কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হয়। এসব মিলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ পড়ে। একে অর্থনীতিবিদরা নির্বাচনী চাপ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

অর্থনীতিবিদরা জানান, বাংলাদেশে নির্বাচনের বছর মানে অস্থিরতার বছর। এবার অস্থিরতা না থাকলেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে। এ অনিশ্চয়তা নির্বাচনের পরও বজায় থাকলে তা অস্থিরতায় রূপ নিতে পারে। ফলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কারণে নতুন বছরে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অর্থনীতির দুঃসময় আরও বাড়বে। ফলে ২০১৮ সালে অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ থাকছে বিনিয়োগ। তাদের মতে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে দেশের বাইরে টাকা পাচার হচ্ছে। এটি আশঙ্কার কারণ। এ প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। আর নির্বাচনমুখী একটি অংশ আগে বাইরে পাচার করা টাকা এনে খরচ করার কারণে অর্থের প্রবাহ বাড়বে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশ থেকে যে পরিমান টাকা পাচার হয়ে তা যদি বিনিয়োগ করা যেতো তাহলে দেমে কোন বেকার থাকতো না। সরকার তার নির্বাচনী ওয়াদা রক্ষা করতে পারতো। সরকার ঠিকই ঘরে ঘরে চাকরি দিতে পারতো। কিন্তু দুনীতি বেড়ে যাওয়ায় পাচারও বেড়েছে। উল্টো কর্মসংস্থান কমেছে।
এজন্য প্রধান দায়ী হলো গণতন্ত্রহীনতা এবং শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকা। গণতন্ত্রে বিরোধেী দল না থাকলে ভার সাম্যহীন হয়ে পড়ে সে দেশের অর্থনীতি। যা প্রভাব স্পষ্ট আমাদের অর্থনীতিতে। কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় দেশে দুর্নীতি বাড়ছেই। কথা বলার কেউ। দুনীতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অর্থপাচার। এতে করে অর্থনীতিতে কালো ছায়া পড়ছে।

সূত্র জানায়, দেশে টানা কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে এক ধরনের মন্দা চলছে। বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত হলেও সমাধান হয়নি। এ কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়েনি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবেও সহজে ব্যবসা করার পরিবেশে (ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট) একধাপ পিছিয়ে ১৭৭ অবস্থানে নেমেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ আগে যত সহজে ব্যবসা করা যেত, আগামী ২০১৮ সালে তা আরও কঠিন হবে। বিনিয়োগের এ পরিস্থিতিতে দেশের ৪ কোটি বেকারের জন্য নতুন চাপ অনুভব করবে অর্থনীতি।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনের বছরই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র্র করে শঙ্কার বাইরে নেই ব্যবসায়ীরাও। তারাও হিসাব করে পরিকল্পনা করছেন।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০১৮ সালজুড়েই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি চলবে। ফলে অর্থনীতি থাকবে এক ধরনের অতিরিক্ত চাপের মধ্যে। তবে সে ঝুঁকি কমিয়ে আনতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া অবকাঠামো ও জ্বালানি সংকট সমাধানে উদ্যোগী হলে অর্থনীতিতে গতি ফিরবে। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে যদি রাজনীতিবিদরা অর্থনীতির ইস্যুতে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে পারে, তা হলে অর্থনীতি ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রতিবছরই এক ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়। ফলে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ বছরও এর বাইরে থাকবে না বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানিতে কিছু প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা ধরে রাখা সম্ভব হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। একই অবস্থা রেমিট্যান্সেও। যদিও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়েছে, সে অনুযায়ী বিনিয়োগ হচ্ছে না। ঋণের অধিকাংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো চ্যালেঞ্জ। যদিও সরকার জমি প্রাপ্তি ও জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নের গতি সন্তোষজনক নয়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, দেশে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচন হলে তাতে অর্থনীতিতে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। এ জন্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে দেশের অর্থনীতির চিত্র। নির্বাচনে জটিলতার সৃষ্টি হলে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কার্যকর কোন বিরোধী দল না থাকাতে সরকারের ওপর কোনধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। এতে করে সরকার দলীয় লোকেরা যাকে খুশি পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করেছে। আবার নিজেদের ইচ্ছা মত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করেছেন তারা। এতে করে দেশের পুরো অর্থ একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে। আর দেশে গনতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকাতে তারাও নতুন করে বিনিয়োগর সাহস পাচ্ছে না। এসব কারনে অর্থনীতিতে এ সংকট স্থায়ী হচ্ছে।

এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকার নানা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। সরকার আগামী নির্বাচনে ইতিবাচক রেজাল্ট দেখতে চায়। ফলে ২০১৮ সালের উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। এ জন্য আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে চলতি বাজেট থেকে খুব একটা পরিবর্তন আসবে না। একই সঙ্গে বসবে না নতুন কর। নির্বাচন মাথায় রেখে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাটের মতো বিশাল রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়েছে। নতুন করে বাড়ানো হবে না তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম। গণপরিবহনের ভাড়াও বাড়ানো হবে না। এসব ব্যবস্থা সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করবে।

এ ছাড়া নতুন বছরে বিশেষ করে নতুন কোনো বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে একনেকে পাস হওয়া নতুন বড় প্রকল্পগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং দৃশ্যমান করা হবে। তবে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি থাকবে বৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই যান চলাচলের জন্য পদ্মা সেতুটি খুলে দিতে চায় সরকার। এই সেতু ঘিরে আরেকটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তা হলো পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপন। সেতুতে যেদিন থেকে যান চলবে, সেদিন থেকেই রেলও চলবে।
পরিকল্পনা কমিশনের একটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপন, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পসহ যে ১০টি প্রকল্পকে ফাস্টট্র্যাকভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই কাজ শেষ করতে চায় সরকার। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এগুলো ভোটারদের সামনে দৃশ্যমান করতে চায়। আঞ্চলিক ও অন্য ভোটারবান্ধব প্রকল্পগুলোও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চায়। এতে টাকার প্রবাহ যেমন বাড়বে, তেমনি মানহীন কাজ ও দুর্নীতিও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সব মিলিয়ে বছর শেষে যেমন মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যেতে পারে, তেমনি পণ্যমূল্যও চাহিদা বাড়ার কারণে বাড়তে পারে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনযাত্রায়। নতুন বছরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বেশি প্রসারিত না হওয়ায় মানুষের আয় বাড়ার সম্ভাবনা কম। এ কারণে জীবনযাত্রার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, বিদায়ী বছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আশানুরূপ আসেনি। এর বড় কারণ অবকাঠামো সমস্যা। বিশেষ করে জ্বালানি সংকট সমাধানে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে কর্মসংস্থান আশানুরূপ বাড়েনি। তবে বড় বড় প্রকল্পের কারণে সরকারি বিনিয়োগে উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক নীতিমালাও বিনিয়োগে বাধার কারণ। তবে নতুন বছরে বিনিয়োগ বাড়বে বলে প্রত্যাশা তার। তিনি বলেন, ১০০টি অর্থনৈতিক জোন তৈরির পরিকল্পনা সরকারের। সেটি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে বিনিয়োগ বাড়ে এবং অর্থনীতিতে ভারসাম্য থাকে। এজন্য শর্ত হলো কার্যকর বিরোধী দল। আর যদি তা না থাকে তাহলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক দিক বেশি দেখা দেয়। নতুন করে কেউ বিনিয়োগের সাহস পায় না। নির্বাচনী বছর হওয়াতে ২০১৮ সালের অর্থনীতি একটু চাপে থাকবে।

http://www.dailysangram.com/post/314275