৬ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৮:১৭

আসছে ভেজাল ওষুধ হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

এক বছরে দুই হাজারের বেশি মামলা। পাশাপাশি ১৭ কোটি টাকার ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ জব্দ ও ধ্বংস করা হয়েছে। সিলগালা করা হয়েছে ৩৭টি প্রতিষ্ঠান। ৫৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। তিন বছরে শত কোটি টাকার মালিক দুলাল

সাখাওয়াত হোসেন : শুধু দেশের ভেতরেই নয়, নানা পণ্যের সাথে চোরাই পথে ও বিমানবন্দর দিয়ে আমদানি করা হচ্ছে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ। সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যে নকল ও ভেজাল ওষুধ ক্রয় করে প্রতারিত হচ্ছেন। একই সাথে এসব ওষুধ সেবনের পর হচ্ছে না কোনো উপকার। ফলে ভেজাল ও নকল ওষুধের কারণে জনস্বাস্থ্য আজ হুমকির মুখে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। রাজধানীসহ সারাদেশে অভিযান চালিয়ে গত এক বছরে দুই হাজারের বেশি মামলা দায়ের করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। গত এক বছরে নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রয়ের অভিযোগে করা মামলার দিকে তাকালেই বিষয়টি অনুমেয়। তার পরও নকল ও ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন বা বিক্রি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি স্বাস্থ্যখাতে ক্রমাগত উদ্বেগ বাড়িয়ে চলেছে। দৃশ্যমান উদ্যোগের পাশাপাশি ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, নকল-ভেজাল, মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধে দেশের বিভাগীয় শহরসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মডেল ফার্মেসি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। বিদেশ থেকেও কয়েকটি চক্র নকল ও ভেজাল ওষুধ এনে বাজারজাত করছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নিয়মিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে অভিযান চলছে। এটা অব্যাহত থাকবে। নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করার কারণে ভেজাল ও নকল ওষুধ আগের চেয়ে অনেক কমেছে। এ জন্য আমাদের টিম সক্রিয় রয়েছে। এ বিষয়ে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন। গত ২৯ ডিসেম্বর সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, গত ২৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে অভিযান চালিয়ে ক্যান্সার প্রতিষেধকসহ জীবন রক্ষাকারী ভেজাল ওষুধ চীনে তৈরি করে দেশে আমদানি করা চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে তাদের গ্রেফতার করা হয়। আটককৃতরা হলোÑ রুহুল আমিন ওরফে দুলাল চৌধুরী, নিখিল রাজবংশী ও মো. সাঈদ। পরে তাদের দেয়া তথ্যে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকায় গোডাউন থেকে ২১ হাজার পাতা ওষুধ জব্দ করা হয়। আটককৃতরা প্রায় সময়ই চীনে যাতায়াত করত। সেখানে গিয়ে চাহিদা অনুযায়ী ভেজাল ওষুধ তৈরির অর্ডার দিত। ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডসহ নিম্নমানের উপাদান দিয়ে নামী-দামি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি করা হতো। এরপর ইলেকট্রনিক সামগ্রী আমদানির আড়ালে কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় এসব ওষুধ কন্টেইনারে করে আমদানি করত এ চক্র। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা তাদের কাছে এমটিএঙ্গ, কোমাইড ও রিভোকন নামের তিন ধরনের ভেজাল ওষুধ পেয়েছি। এসব ওষুধ প্রতি পাতা তৈরি এবং আমদানিতে ব্যয় হতো ১২ টাকা। যা দেশে প্রতি পাতা বাজার মূল্য দুই থেকে তিন শ’ টাকা। আর তারা এজেন্টদের কাছে ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি করত। তিনি আরো বলেন, চক্রটি চায়না থেকে ভেজাল ওষুধ এনে একটি গোডাউনে রাখত। তারপর ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন বাজারে ছড়িয়ে দিত। জীবন রক্ষাকারী এসব দামি ওষুধে ভেজালের ফলে মানুষ চরমপর্যায়ে প্রতারিত হয়েছে। সিআইডি ও স্থানীয় সূত্র জানায়, দুলাল মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার ভাগ্যকুল এলাকার পান্নু চৌধুরীর ছেলে। এলাকায় সে জুয়াড়ি দুলাল নামে পরিচিত। নকল ওষুধের কারবার করে এলাকায় গড়ে তুলেছে বিলাসবহুল বাংলো। ঢাকায় রয়েছে তার নামে একাধিক ফ্ল্যাট। আবার জুয়ার আসরে গিয়ে প্রতিদিন উড়ায় লাখ লাখ টাকা। দুলাল খুবই চতুর ব্যবসায়ী। প্রথমে আসল ওষুধের ব্যবসা করলেও জুয়ার বোর্ডে অনেক টাকা হেরে যাওয়ার পর শুরু করে নকল ওষুধের ব্যবসা। দেশের বাজারে বিক্রি হয় এমন বিদেশি ওষুধ নকল করে চীন থেকে তৈরি করিয়ে আনত সে। আর এসব বিক্রি করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। সিআইডি সূত্র জানায়, চীন থেকে মোবাইল, টিভির পর এবার নকল ওষুধ তৈরি করে দেশে সরবরাহ শুরু করেছে বেশ কয়েকটি চক্র। আর ওইসব মরণ ওষুধ দেশে আনা হচ্ছে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে। এ কাজে তাদের সহায়তা করছে কাস্টমসের কিছু অসাধু সদস্য। সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছরের ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধ্যানে দেখা গেছে, শত শত কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে লেনদেন করেছে ওই চক্রের সদস্যরা। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সারা দেশে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত মামলা করেছে দুই হাজার ১৬৯টি। এর বাইরেও একই অভিযোগে ড্রাগ আদালতে মামলা হয়েছে। আর গত এক বছরে ড্রাগ আদালতে মামলা হয়েছে ৪১টি ও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ৬৪টি। মামলার পাশাপাশি ছয় কোটি ৬৬ লাখ টাকারও বেশি জরিমানা করা হয়েছে। ১৭ কোটি টাকার ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ জব্দ ও ধ্বংস করা হয়েছে। সিলগালা করা হয়েছে ৩৭টি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ৫৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) গাইডলাইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা এবং ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের দায়ে এ পর্যন্ত ৮৬টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। আর ১৮টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স চ‚ড়ান্তভাবে বাতিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয় সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে। যার একটি শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ওষুধ নকল (বোতল ও লেবেল লাগিয়ে) করে। অন্যটি পরিমাণ ও গুণগত মানের সঙ্গে আপস করে নিম্নমানের ওষুধ তৈরি। ফলে এসব ওষুধ ব্যবহারে কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না। অনেক সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়।

https://www.dailyinqilab.com/article/111468