৬ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৮:১৫

এমপিও’র অব্যয়িত ৬১৪ কোটি টাকা

কোষাগারে জমা দেয়ার আগ্রহ নেই মাউশি’র!

নয় মাস আগে অর্থ জমা নিশ্চিত করে ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও সংঘটিত অনিয়মের ব্যাখ্যা অর্থ মন্ত্রণালয় চাইলেও অদ্যাবধি মেলেনি জবাব
মুসতাক আহমদ ও মিজান চৌধুরী ০৬ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এমপিও খাতের অব্যয়িত প্রায় ৬১৪ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে নিয়মবিহর্ভূতভাবে নিজস্ব হিসাবে (অ্যাকাউন্টে) রেখেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। এমনকি নয় মাস আগে অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিলেও অদ্যাবধি সাড়া দেননি সংশ্লিষ্টরা। এমপিও সুবিধা স্থগিত, শিক্ষকের অবসর ও মৃত্যুসহ বিভিন্ন কারণে ব্যয় না হওয়া এই অর্থ ১০ বছর ধরে জমা হয়েছে।

বিধান অনুযায়ী অব্যয়িত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা দেয়ার কথা। কিন্তু মোটা অঙ্কের এই অর্থ রহস্যজনক কারণে জমা রাখা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকে। ঘটনা উদঘাটনের পর কোষাগারে অর্থ জমা নিশ্চিত করে ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও সংঘটিত অনিয়মের ব্যাখ্যা মাউশির কাছে চায় অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু অদ্যাবধি ওই অর্থ কোষাগারে জমা পড়েনি। শুধু তাই নয়, ওই ব্যাখ্যা দেয়ার ব্যাপারেও কোনো সাড়া দেয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, অব্যয়িত অর্থ অনুদান বণ্টনকারী ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা মাঠ পর্যায়ে রাখে। কারণ কোনো শিক্ষক তার বেতন-ভাতা (এমপিও) তুলতে না পারলে পরে যেন উত্তোলন করতে পারেন। তবে অর্থবছর শেষে অব্যয়িত টাকা ব্যাংকের শাখাগুলোর প্রধান কার্যালয়ে ফেরত পাঠানোর বিধান রয়েছে। পরবর্তী সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি বলেন, যে অব্যয়িত অর্থ ফেরত আনতে পারিনি, সেটার ব্যাপারে চারটি ব্যাংকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। জানতে পেরেছি কোনো কোনো ব্যাংকে প্রধান কার্যালয়ে অর্থ চলে এসেছে। আবার মাঠপর্যায়েও আছে। তবে যেখানেই থাকুক না কেন, তা সংরক্ষিত আছে বলে আমাদের অবহিত করা হয়েছে। আগামী দেড়-দু’মাসের মধ্যে আমরা তা ফেরত পাওয়ার আশা করছি।

বর্তমানে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমপিও দেয়া হয়ে থাকে। এ খাতে বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বরাদ্দের প্রায় ৬৪ শতাংশ অর্থই ব্যয় হয়। যার পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মাসের শেষে সারা দেশে এমপিওর বিপরীতে বেতনের সব টাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় করা হয়। অনেক সময় এমপিও স্থগিত, অবসর, মৃত্যু, শিক্ষকের পদত্যাগ ও অন্য প্রতিষ্ঠানের নিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে অর্থ অব্যয়িত থেকে যায়। এভাবে গত দশ বছরে ৬১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা অব্যয়িত অর্থ জমে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে আসে। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র মতে, গত বছরের ১০ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বাজেট বৈঠকে এ টাকা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এই টাকা রাষ্ট্রের কোষাগারে দ্রুত জমা দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে। পাশাপাশি এই অনিয়মকে গুরুতর ‘ক্রাইম (অপরাধ) বলে মন্তব্য করেন অর্থসচিব। এরপর বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে ওঠে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর।

ওই বৈঠকের দু’দিন পর ১২ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ফাইন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট উইং প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী এর কারণ ও ব্যাখ্যা চেয়ে কলেজ ও প্রশাসনিক/ মাধ্যমিক পরিচালকের বরাবর একটি চিঠি ইস্যু করেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, বাজেটবিষয়ক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অর্থসচিব মাউশির এমপিও খাতে অব্যয়িত ৬১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিত করতে বলেছেন। পাশাপাশি ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও এই অনিয়মের কারণ ব্যাখ্যাসহ রিপোর্ট অর্থ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরকে নির্দেশ দেয়া হয়। সেখানে আরও বলা হয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এই অনিয়মকে গুরুতর ক্রাইম বলে উল্লেখ করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তিন কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ করা হয় ওই চিঠিতে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি কোন ব্যাংককে কত টাকা আছে, সে ব্যাপারেও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কেউ।

এ প্রসঙ্গে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এমপিও কার্যক্রম দেখার জন্য মাউশির একটি পৃথক শাখা আছে। বিষয়টি তারা বলতে পারবেন। তিনি চিঠি পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে মাউশির সাধারণ শাখা। এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।
এ বিষয়টি জিজ্ঞাস করতেই বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন মাউশির উপপরিচালক সফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, তারা (ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী) আমাদের এ বিষয়টির সঙ্গে জড়ায় কেন। এটির হিসাব তারাই রাখেন। তিনি আরও বলেন ‘আপনি তার কাছ থেকে লিখিত নিয়ে আসেন যে, আমি বিষয়টি জানি।’ এক প্রশ্নের জবাবে এই উপপরিচালক বলেন, টাকার বিষয়ে আমরা শুধু ব্যাংকে চিঠি দিয়েছি, ব্যাংক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে ব্যাংকে আগের কোনো অর্থবছরের টাকা থাকার কথা নয়। কেননা প্রতি অর্থবছরের অব্যয়িত টাকা ফেরত আসে।

বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব (বর্তমানে অবসরে) হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, অব্যয়িত অর্থের ব্যাপারে আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু সর্বশেষ অবস্থা আমার জানা নেই।
সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বুধবার যুগান্তরকে বলেন, বাজেটে প্রতি বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ দেয়া হয়। তাদের কাছে অব্যয়িত অর্থ থাকলে সমন্বয় না করে নিজেদের কাছে রেখে দেয়া হলে তা যৌক্তিক হবে না। অর্থবছর শেষে অব্যয়িত অর্থ ফেরত দিতে হবে। অথবা অব্যয়িত অর্থ পরবর্তী বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। তবে মাউশির এমপিও খাতের অব্যয়িত অর্থের সর্বশেষ অবস্থা তার জানা নেই বলে মন্তব্য করেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মাউশির এমপিও খাতের অব্যয়িত টাকা দীর্ঘদিন নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছে শিক্ষা অধিদফতর। প্রতি বছর বাজেট প্রণয়ন হলেও সে টাকার হিসাব আলাদাভাবে রাখা হতো। বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় করা হতো না। ফলে ওই টাকা ব্যাংকে ধরে রাখায় বড় ধরনের আর্থিক সুবিধাও ভোগ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আইন অনুযায়ী প্রতি অর্থবছরের বরাদ্দ টাকা ওই বছরেই শেষ করতে হবে। আর যে টাকা ব্যয় হবে না তা বছর শেষে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর আইনটি জেনেও অমান্য করেছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের একজন পরিচালক বলেন, প্রতি বছর এমপিও খাতে অব্যয়িত অর্থ জুনের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয়। অব্যয়িত টাকা প্রতি বছর সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু তা জমা না হলে অবশ্যই এটি গুরুতর অন্যায়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/3463