৬ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ৮:০৪

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথকতা

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

দেশ, জাতি-রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য কিছু করার সুযোগ আমাদের জন্য তেমন একটা থাকে না। যা কিছু করি তার প্রায় সবই আত্মকেন্দ্রিক। এমনটি ঘটতে যাচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারার ক্ষেত্রে।
গণমানুষের কল্যাণের ধারণা থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির ব্যুৎপত্তি ঘটেছে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত রাজনীতির লক্ষ্যচ্যুতি ঘটেছে বলেই মনে হয়। ক্ষমতাসীনদের ধ্যান-জ্ঞান জনকল্যাণের পরিবর্তে হয়েছে আত্মকেন্দ্রিক। আর যারা ক্ষমতার প্রভাব বলয়ের বাইরে রয়েছেন, তাদের অবস্থাও প্রায় একই রকম। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতা রক্ষায় সব সময় ব্যস্ত। প্রয়োজনে গণনিগ্রহ ও মানুষের অধিকার ক্ষুণœ করতেও কুণ্ঠাবোধ করা হচ্ছে না। মূলত ক্ষমতা রক্ষাই যেখানে মুখ্য, সেখানে জনগণের অধিকার তো গৌণ হবেই।

গণতন্ত্র আমাদের দেশের সংবিধানের উচ্চতম স্তম্ভ। আর গণতন্ত্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। আর এসব কিছুর পূর্ণ প্রতিফলন থাকলে তো ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা নিরাপদ হয় না। সরকার পক্ষ দাবি করেছে, এই আইনের ৫৭ ধারার কোনো অপপ্রয়োগ করা হয়নি বা সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু জানা যায়, এই আইনের আওতায় অনলাইন পোর্টাল বাংলা মেইলের সাংবাদিক শাহাদাত উল্লাহ খান, মাকসুদুল হায়দার চৌধুরী ও প্রান্ত পলাশ, শিক্ষা ডটকম সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, দৈনিক ইনকিলাবের রবিউল্লাহ রবি, রফিক মোহাম্মদ, শাখাওয়াত হোসেন বাদশাহ, শাখাওয়াত হোসেন, আহমদ আতিক ও আফজাল বারী গ্রেফতার হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে এই আইনে সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। আত্মকেন্দ্রিক অপরাজনীতির কারণেই আইনটি নিবর্তনমূলক আইনে পরিণত হয় এবং তা বাতিলের পক্ষে জোরালো জনমত গড়ে ওঠে।
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের তীব্র সমালোচনার মুখে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করতে যাচ্ছে সরকার। এমনটিই জানা গেছে। তবে এখানেও শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রস্তাবিত নতুন আইনে আগের বিষয়গুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাখা হচ্ছে। ৫৭ ধারায় অপরাধের ধরনগুলো একসাথে লেখা ছিল, নতুন আইনে সেগুলো বিভিন্ন ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হচ্ছে। তাই নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বলে মনে করা হচ্ছে।

আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, এই আইন কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল কিংবা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে অথবা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনি¤œ সাত বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আছে।

অপরাধের এই সংজ্ঞা, আইনের অজামিনযোগ্য ধারা ও শাস্তির বিষয় আইনটিকে বিতর্কিত করে তোলে। এর অপব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা নেয়ার আগে পুলিশ সদর দফতরের অনুমতি নিতে থানাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া আসামি সাংবাদিক হলে এ ধরনের মামলার বিষয়ে দলের সাথে পরামর্শ করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অপরাধের ধরনগুলো বিভিন্ন ধারায় অন্তর্ভুক্ত করে শাস্তির মাত্রা কমানো হয়েছে। খসড়ার ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার ইচ্ছায় ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে ওই ব্যক্তির সেই কাজ হবে অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করলে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। এই ধারার অপরাধ আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য।
আইনের খসড়ার ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানি-সংক্রান্ত দণ্ডবিধির (১৮৬০) সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। আর ওই অপরাধ দ্বিতীয় বা তার বেশিবার করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। এই ধারার অপরাধ অ-আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আদালতের সম্মতিসাপেক্ষে আপসযোগ্য হবে।
আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে ওই ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। আরেকটি ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ সংস্থার গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ। এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয় বা এর বেশিবার করেন, তাহলে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের বাইরে এই আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধ করেন, যা দেশে করলে দণ্ডযোগ্য হতো, তাহলে সেটি দেশের ভেতরে হয়েছে বলে গণ্য করা হবে।

আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই বিতর্ক চলছে। কারণ এতে মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ বছরের জানুয়ারি মাসে আইসিটি আইনে ৪২টি মামলা হয়েছিল। জুনে তা বেড়ে হয়েছে ৭৯টি। এই ছয় মাসে মোট মামলা হয়েছে ৩৯১টি। ওই সব মামলার বেশির ভাগই দায়ের করা হয় ৫৭ ধারায়। এসব মামলায় আসামি ৭৮৫ জন, যাদের ৩১৩ জন গ্রেফতার হয়েছেন। এই সময়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা হয় ৫৭ ধারায়। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নামে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়। মাদারীপুর সদর থানায় করা এই মামলার বাদি নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাগ্নে সৈয়দ আসাদউজ্জামান মিনার।
আইসিটি আইনটি প্রথমে প্রণয়ন করা হয়েছিল ২০০৬ সালে। পরে ২০১৩ সালে সংশোধন করে শাস্তি বাড়িয়ে সেটিকে আরো কঠোর করা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। প্রথমে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০১৫’ নাম দেয়া হলেও পরে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন-২০১৬’ নাম দেয়া হয়। এটি মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেয়ার পর আইনটি পর্যালোচনার জন্য আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কাছে পাঠানো হয়। সম্প্রতি কমিটি খসড়াটি চূড়ান্ত করেছে।

মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (আইসিটি), বিশেষ করে ৫৭ ধারাসহ এই আইনের নিবর্তনমূলক ধারা এবং বর্তমানে প্রস্তাবিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ এর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য দেখছেন না অভিজ্ঞ মহল। এর কারণ, প্রস্তাবিত নতুন আইনে কথামালার মারপ্যাঁচ ছাড়া অভিনবত্ব বলে কিছুই নেই। ৫৭ ধারায় যা একত্রে ছিল তা নতুন আইনের বিভিন্ন ধারায় সন্নিবেশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। নতুন আইন সম্পর্কে সরকার ছেলেভোলানোর মতো বলছে ৫৭ ধারা থাকবে না। এখন যদি ওই ধারার অপরাধগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধারায় রাখা হয়, তাহলে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হলো কিভাবে এ প্রশ্ন এখন সর্বমহলে।
smmjoy@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/282547