৫ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৫৪

নকল বিদেশি ইলিশে বিপদ

পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করল খাদ্য কর্তৃপক্ষ

দেখতে ইলিশের মতো কিন্তু ইলিশ নয়। বরং এগুলোতে রয়েছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উচ্চমাত্রার ভারী ধাতু। কলম্বো ও চন্দনা নামের এমন মাছ দেদার আমদানি হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এবং দেশের বাজারে ইলিশ নামে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা এসব মাছ ল্যাব টেস্ট ছাড়াই বন্দর থেকে ছাড় করে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ইলিশের নামে! এতে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছে, এসব মাছ মারাত্মক অনেক রোগেরও কারণ হচ্ছে।

কালের কণ্ঠ’র হাতে আসা এক নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা যায়, আমদানি করা কলম্বো (স্বাদ) মাছে প্রতি কেজিতে সহনীয় মাত্রা ক্যাডমিয়াম দশমিক ২৫ মিলিগ্রাম কিন্তু মিলেছে প্রায় তিন গুণ বেশি—দশমিক ৬৯ মিলিগ্রাম, সিসার সহনীয় মাত্রা দশমিক ৩ মিলিগ্রাম, পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৬৩ মিলিগ্রাম। চন্দনা (গিজার্ড স্বাদ) মাছেও সিসা পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৫৫ মিলিগ্রাম।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছাড় হওয়া বেশ কিছু সামুদ্রিক মাছের চালান ঢাকার নামকরা ল্যাবে পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। সেখানে এই দুই মাছে ক্ষতিকর পদার্থ পায় উচ্চমাত্রায়। এর পরই কর্তৃপক্ষ গত ১ জানুয়ারি এক চিঠিতে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা সব মাছ বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়েছে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও সরকারের যুগ্ম সচিব মাহবুব কবীর চিঠিটি দিয়েছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানি করা সব মাছে অতিমাত্রায় হেভি মেটাল বিশেষ করে সিসা বা লেড, ক্রোমিয়াম ও মার্কারি পাওয়া যাচ্ছে, যা জনস্বার্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমদানি করা সব মাছ খালাসের আগে অ্যাটমিক এনার্জি, বিসিএসআইআর ঢাকা, ফিশ কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাব, ঢাকা থেকে পরীক্ষা করে নির্ধারিত মাত্রায় পাওয়া গেলে খালাসের অনুমতি প্রদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।’ মাহবুব কবীর বলেছেন, ‘এর আগে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপের পর থেকেই মাছে ও ফলে ফরমালিন আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রতিটি চালানের শতভাগ পরীক্ষা করে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করব। যদি দেখা যায় আর ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলছে না, তাহলে এই আদেশ প্রত্যাহার করা হবে।’
চিঠি পাওয়ার পরের দিন ২ জানুয়ারি বিকেলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এক অফিস আদেশ জারি করে শতভাগ চালান পরীক্ষার নির্দেশ দেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে সহকারী কমিশনার বায়েজিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এর পর থেকে গত দুই দিনে এই ধরনের মাছের কোনো চালান শুল্কায়নের জন্য বিল অব এন্ট্রি জমা পড়েনি। যদিও অনেক চালান বন্দরে রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. দীপন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের মাছ খেলে তাত্ক্ষণিকভাবে ক্ষতি বোঝা যাবে না, তবে ধাপে ধাপে লিভার ও কিডনির কর্মক্ষমতা নষ্ট হবে। দীর্ঘ মেয়াদে এসব পদার্থ শরীরের জন্য নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে।’ তিনি আরো বলেন, আমদানি করা মাছ ছাড়াও দেশে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত মাছে এই বিষয়গুলো কঠোরভাবে দমন করা উচিত।
এ নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রামের খুচরা বাজার কাজীর দেউড়ির মাছ বিক্রেতা আবদুল হামিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দেশি ইলিশের তুলনায় এসব মাছের দাম অনেক কম, তাই বেশি লাভের আশায় কেউ কেউ এই মাছ আমদানি করছেন এবং বাজারে ইলিশ বলে বিক্রি করছেন। এই ক্রেতা ঠকানোর কাজ আমরা করি না।’
২০১৬ ও ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শুধু সামুদ্রিক মাছ আমদানি করা হয়েছে প্রায় এক লাখ টন। সেগুলো হেভি মেটাল বা ভারী ধাতু উপস্থিতির পরীক্ষা ছাড়াই বন্দর থেকে ছাড় হয়েছে! তবে কাস্টমস সহকারী কমিশনার বায়েজিদ হোসেন বলেছেন, ‘মত্স্য অধিদপ্তরের নির্দেশে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে হেভি মেটালের উপস্থিতি নিশ্চিত হতে আমরা আমদানি চালানের ১০ ভাগের এক ভাগ বাছাই করে নমুনা পরীক্ষা করেছি কিন্তু কোনো ক্ষতিকর পদার্থ পাইনি।’ শতভাগ চালান পরীক্ষা না করার বিষয়ে তিনি বলেন, আমদানি নীতি, কিংবা কোনো সরকারি অধিদপ্তর থেকে শতভাগ পরীক্ষার কোনো নির্দেশনা না থাকায় সেটি বাস্তবায়ন করা যায়নি।
এ পরীক্ষা নিয়েও যে প্রতারণা হয় তা একাধিক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। তাঁরা বলেন, নমুনার বেশির ভাগই আমদানি করা পণ্যের কনটেইনার থেকে নেওয়া হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে কনটেইনার থেকে নমুনা নিলেও কাস্টমসে জমা হওয়ার আগে মাঝপথে সেটি বদল করা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমস ল্যাবেও রিপোর্ট পাল্টানোর ঘটনা আছে বহু। এ কারণেই বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ছাড় হওয়া বেশ কিছু সামুদ্রিক মাছের চালান ঢাকার নামকরা ল্যাবে পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় এবং তাতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পায়।

চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের হিসাবে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দুই বছরে ৫২৯ কোটি টাকার মাছ আমদানি করা হয়েছে। ২০১৬ সালে সাড়ে ৪৭ হাজার টন সামুদ্রিক মাছ আমদানি করা হয়েছে, যার মূল্য ১৩২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সরকার শুল্ক পেয়েছে সাড়ে ৭২ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালে আমদানি কিছুটা বেড়ে সাড়ে ৪৮ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। এই মাছের মূল্য ২১১ কোটি টাকা আর শুল্ক ছিল ১১৪ কোটি টাকা।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/01/05/585890