৫ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৫১

অনশনে অসুস্থ ১০১ শিক্ষক

মায়ের বড় আশা ছিল সন্তানের চাকরির বেতন নেবেন। সেই আশায় ১৮ বছর ধরে কুষ্টিয়ার কে.এইচ.এন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন মজিবুর রহমান। বিনা বেতনের এই শিক্ষক আশায় ছিলেন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হলে হাতে বেতন পাবেন। তা তুলে দেবেন মায়ের হাতে। কিন্তু তার স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। ৪ বছর আগে মারা যান মজিবুরের মা।

সেই থেকে মজিবুরের মন ভেঙে যায়। ব্যাপক ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গত ২৬শে ডিসেম্বর থেকে অবস্থান কর্মসূচি ও আমরণ অনশন কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি। পাহাড়সম অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার এই শিক্ষক মানবজমিনকে বলেন, আশায় আশায় মাকে হারালাম তবুও বেতন হলো না। এখন রাতের পর রাত ফুটপাথে শুয়ে কাটাচ্ছি। তবুও সরকারের দয়া হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে প্রেস ক্লাবে শিক্ষক মজিবুর রহমানের মতো হাজার হাজার শিক্ষক টানা অবস্থান কর্মসূচির পর রোববার থেকে ৫ দিনের মতো আমরণ অনশন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর থেকে দেশের সব নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গতকালের অনশনে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষকের উপস্থিতি ছিল। তাদের মধ্যে নতুন করে ১৪ জন অসুস্থ হয়ে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১০১ জন শিক্ষক অসুস্থতা নিয়েই অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন।

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের ডাকে সরকার স্বীকৃত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবি নিয়ে এ অনশন কর্মসূচি চলছে। সংগঠনের সভাপতি গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, টানা ১০ দিন ধরে শিক্ষকরা রাস্তায় পড়ে কান্নাকাটির পরও সরকার দাবি মেনে নিচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রী দেখতে এলেও স্পষ্ট দাবি পূরণের কথা বলেননি। এখন থেকে দেশের সব শিক্ষককে অনশনে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ক্রমেই শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ছে। সবার এক দাবি এমপিওভুক্তিকরণ ছাড়া কেউ বাড়ি ফিরে যাবো না। একইভাবে প্রেস ক্লাবের মূলগেটের বাম পাশে মাদরাসা বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলো জাতীয়করণের দাবিতে চতুর্থদিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষক সমিতি। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রুহুল আমীন চৌধুরী বলেন, আমরা দাবি আদায়ে সরকারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে আবেদন করে আসছি। আশ্বাস দিলেও তার বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের সমমানের দাবিতে আমাদের এই কর্মসূচি। দাবি পূরণ করা না হলে সামনে কঠোর কর্মসূচি দেয়ার হুমকি দেন তিনি। গতকাল সকাল ১০টায় অনশনস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, শতাধিক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে ফুটপাথে খবরের কাগজের ওপর শুয়ে আছেন। তাদের অনেকের হাতে স্যালাইন লাগানো। টানা কর্মসূচির ক্লান্তিতে অনেকের চেহারা বিমর্ষ দেখাচ্ছে। তাদের মধ্যে বেশ অসুস্থ নেত্রকোনার পশ্চিমেন্ধী দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক রোকেয়া বেগম। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ১৮ বছর ধরে বেতন পাই না- এটা যেমন কষ্টের। তেমনি সারা রাত কনকনে শীতে খোলা আকাশের নিচে নির্ঘুম আরো কষ্টের। আমরা কতো কষ্টে দিন-রাত কাটাচ্ছি যদি প্রধানমন্ত্রী এসে এক নজর দেখতেন তাহলে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। চলমান আন্দোলনের শুরুতে শিক্ষকদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে টানা আমরণ অনশনের ক্লান্তিতে সে উদ্যমতা হারিয়ে ফেলছেন শিক্ষকরা। দুদিনের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকায় আসলেও ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও সে দাবি পূরণ না হওয়াতে অনেকে না খেয়ে পড়ে আছেন কর্মসূচিতে। তাদের মধ্যে ঠাকুরগাঁও রাণীশংকৈল মহিলা টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের শিক্ষিকা আনসারা বেগমের চারদিন আগেই টাকা শেষ হয়ে গেছে। এতদিনের কর্মসূচির পরও দাবি পূরণ না হওয়ায় হতাশ হয়ে এ শিক্ষক বলেন, প্রচণ্ড শীতের রাতে মশার কামড়ে যেমন ঘুমাতে পারি না তেমনি সারাদিন টাকার অভাবে অভুক্ত রয়েছি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=99163