৫ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৩৯

পার্বত্য অঞ্চলে নতুন আতঙ্ক

পাহাড়ে সশস্ত্র গ্রুপগুলো আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ইউপিডিএফ ভেঙে যাওয়ার পর এখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে আঞ্চলিক দল ও উপদলগুলোর মধ্যে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এরই মধ্যে গতকাল সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে ইউপিডিএফের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি মিঠুন চাকমাকে।

পার্বত্য জেলাগুলোয় পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও প্রভাব বিস্তারের ঘটনায় একের পর এক খুন খারাবি হচ্ছে। খুনোখুনির কারণে আতঙ্ক বাড়ছে পার্বত্য জনপদে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। পার্বত্য জেলায় তিনটি আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে শান্তিচুক্তির বিরোধিতাকারী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সশস্ত্র সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে বেশি বেপরোয়া বলে অভিযোগ উঠেছে। ১৯ বছর বয়সী এই সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নিজ দলের নেতাকর্মীকে খুন করার অভিযোগ এনে গত মাসে ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ নামে নতুন একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এরই মধ্যে খুনের শিকার হলেন মিঠুন চাকমা। গতকাল কোর্টে হাজিরা শেষে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নিজ বাড়িতে গেলে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তাকে অপহরণ করে স্লুইস গেট এলাকায় নিয়ে তার পেটে ও মাথায় গুলি করে ফেলে যায়। সেখান থেকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ২০০১ সালে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্রপরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা শাখার আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মিঠুন চাকমা। হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী রীনা দেওয়ানের স্বামী মিঠুন চাকমা খাগড়াছড়ি সদর থানার বিস্ফোরক দ্রব্য আইন (জিআর ১৯১/১৪) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনসহ (জিআর ১১৫/১৬) একাধিক মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ২০১৬ সালের ১২ জুলাই খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ তাকে আটক করে। ১৮ অক্টোবর তিনি জামিনে মুক্ত হন। এর পর থেকেই সাংগঠনিক কাজে কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন মিঠুন চাকমা। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় ধরা পড়ার পরও জামিনে মুক্তি পাওয়ায় পার্টির একাংশে তাকে নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। তবে শোনা যায়, তিনি আঞ্চলিক রাজনীতি ত্যাগ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছিলেন।

প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ১৯ বছর পর গেল ১৫ নভেম্বর দুই ভাগে বিভক্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রভাবশালী পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ। বিভক্তির পর সংগঠনটির কোনো নেতা এই প্রথম হত্যার শিকার হলেন। ইউপিডিএফ ভেঙে দুই ভাগ হওয়ার মধ্য দিয়ে পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২০ বছরে চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের জন্ম হয়। ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়ির খাগড়াপুরে একটি কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। ইউপিডিএফ থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কৃত ও জনসংহতি সমিতির সংস্কারপন্থী অংশের কিছু নেতাকর্মী এই দলটি গঠনের পেছনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’-এর প থেকে সংগঠনটি ভাঙার কারণ জানিয়ে পার্বত্যবাসীর কাছে ‘খোলা চিঠি’ বিলি করা হচ্ছে। এতে সেখানে ইউপিডিএফ নেতাদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নিজ দলের নেতাকর্মীকে খুন করাসহ নানা অভিযোগ তোলা হয়েছে। খোলা চিঠিতে ইউপিডিএফের কাছে যারা জিম্মি রয়েছেন তাদের একজোট হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তিবিরোধী বিশেষ মহলের প্ররোচনায় ইউপিডিএফ নাম দিয়ে জুম জনগণের একটা অংশকে বিভ্রান্ত। জুম জনগণের একটা অংশ এই জঙ্গিচক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কারণ, এই সংগঠনে যোগ দেয়া যায় কিন্তু সরে আসার কোনো সুযোগ থাকে না। ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’-এর ১৬ পৃষ্ঠার খোলা চিঠিতে সংগঠন ভাঙার কারণ উল্লেখ করে বলা হয়, ‘আমরা জুম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সংগঠনের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের প্রতি আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল। কিন্তু মুখোশের আড়ালে নেতাদের যে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা ছিল আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। সময়ের পরিক্রমায় তাদের মুখোশ উন্মোচিত হলে আমরা বিষয়টি বুঝতে পেরে পার্টির নিয়ম অনুযায়ী সমালোচনা ও দ্বন্দ্ব নিরসনে গঠনমূলক উপায়ে পার্টির ভাবমর্যাদা রার চেষ্টা করেছি। পার্টির নেতৃত্ব দুর্নীতিবাজ নেতাদের রা করে সৎ ও যোগ্য নেতাকর্মীদের পদে পদে বঞ্চিত করেছে। চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘এসব কারণে আজ সঞ্জয় চাকমা, দীপ্তি শংকর চাকমা, দীপায়ন খীসা, অভিলাষ চাকমা, সমীরণ চাকমা, অনিল চাকমা (গোর্কি), নিকোলাস চাকমা, দিলীপ চাকমা, পুলক চাকমা, দীপায়ন চাকমা, ধ্রুবজ্যোতি চাকমাসহ আরো অনেক নেতা-কর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে দেশে-বিদেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে পার্টি কর্তৃক অনিল চাকমা ও অভিলাষ চাকমাকে খুন করা হয়। এ ছাড়া অনিল চাকমার অনুসারী সন্দেহে লক্ষ্মীছড়িতে রয়েল মারমাকে পেছন থেকে সুপরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই কায়দায় রঞ্জন মুনি চাকমার (আদি) নেতৃত্বে বাঘাইছড়ির জারুলছড়িতে তার শ্বশুরবাড়িতে সাহসী ও দ কর্মী স্টেন চাকমাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।’ খোলা চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘এ অবস্থায় আমরা পার্টির সৎ, যোগ্য ও পরিশ্রমী নেতাকর্মীরা নির্লিপ্ত থাকতে পারি না। মূলত ইউপিডিএফের মধ্যে একটি সিন্ডিকেট নিজেরা অর্থশালী ও সম্পদশালী হতে তৎপর। দায়িত্ব পালনের চেয়ে নিজের স্বার্থে অর্থ, খ্যাতি ও পদবি লাভের দিকে তাদের নজর বেশি। এসব নেতার সুযোগের শুরুতে ও বিপদের শেষে দেখা মেলে।’ খোলা চিঠিতে পার্টির কেন্দ্রীয় কালেক্টর রবিচন্দ্র চাকমা (অর্কিড/অর্ণব), সমাজপ্রিয় চাকমা, জেএসএস থেকে বহিষ্কৃত প্রগতি চাকমা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব চাকমা, সুনেন্দু চাকমা, সমশান্তি চাকমা, কাঞ্চন চাকমা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রদীপন খীসা, কালোপ্রিয় চাকমা, শান্তিপ্রিয় চাকমা, সমির চাকমা, সুগত, জ্যোতিবিন্দু চাকমা, হ্যাচ্ছ্যা চাকমা, রাঙ্গ্যা চাকমা, রঞ্জনমুনি চাকমার দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়।

ধারণা করা হচ্ছে পার্টি ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরেই খুন হয়েছেন মিঠুন চাকমা। দলের শীর্ষ স্থানীয় অনেকেই সম্প্রতি তাকে সন্দেহ করে আসছিলেন। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বলেছে বিষয়গুলো তারা খতিয়ে দেখছে। এদিকে, মিঠুন হত্যার পরে পুরো পার্বত্য অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঘটনার জের ধরে আরো খুনোখুনির ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/282240