৫ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৩৭

একতরফা নির্বাচনের দিন

আলোচিত ও সমালোচিত ৫ জানুয়ারি আজ

বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ৫ জানুয়ারি আজ। দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক ঘটনাবহুল দিন। ২০১৪ সালের এই দিনে দেশী-বিদেশী নানা ধরনের অনুরোধ ও চাপ আমলে না নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিরোধী জোটকে বাইরে রেখেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নব্বই সালে স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর এই প্রথমবার দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ‘একতরফা’ এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ জোট। অথচ তার আগেই ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন নিশ্চিত করা হয়, যা দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

এর আগে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিবাদে টানা হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি জোট। এমনকি এ সময় দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পরে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় সরকার ও বিরোধী পরে মধ্যে নির্বাচন ইস্যুতে সংলাপ হলেও উভয় পক্ষ কোনো ধরনের সমঝোতায় আসতে পারেনি। তবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রায় এ নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার কথা তুলে ধরে ছয় মাসের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক আরেকটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবেÑ এমন আশ্বাস দেয় সরকারপ। জাতিসঙ্ঘের অনুরোধে বিএনপি জোটও সেই আশ্বাসে কিছুটা সম্মতি দেয়। ফলে ‘ভোটারবিহীন’ এ নির্বাচনের পরও বিএনপি জোট আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করে দল গোছানোর কাজে মনোযোগ দেয়। তবে নির্বাচনের চার বছর পার হলেও সরকার নতুন কোনো নির্বাচনের ব্যবস্থা করেনি। উল্টো তারা এ নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপে দাবি করে পাঁচ বছর সাংবিধানিক মেয়াদের অজুহাত দেখিয়ে বিরোধীদের দমন-পীড়নে মনোযোগ দেয়। বিএনপি জোটকে কোণঠাসা অবস্থায় রেখেই সরকারের মেয়াদ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন আবারো নির্দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজনের দাবিতে অনড় রয়েছে বিএনপি জোট। অন্য দিকে এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ আখ্যা দিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট রাজধানীসহ সারা দেশে কালো পতাকা মিছিল, বিােভ ও সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে। তবে বারবার আবেদনের পরও বিএনপিকে আজ শুক্রবার রাজধানীতে কোনো ধরনের সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি।
অন্য দিকে এ দিনকে ‘সংবিধান রক্ষা ও গণতন্ত্রের বিজয়’ দিবস দাবি করে মতাসীন আওয়ামী লীগ জোটও সারা দেশে আনন্দর্যা লি, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে মহানগর দক্ষিণ এবং বনানী মাঠে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ পৃথক দুইটি সমাবেশ করবে।

নব্বইয়ের পর নির্দলীয়, নিরপে ও অবাধ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়। এ ব্যবস্থায় পরপর চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলুপ্তির আদেশ দেন। তবে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে পরবর্তী দুই মেয়াদে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বহাল রাখা যেতে পারে বলেও পর্যবেণ দেন আদালত। কিন্তু মতাসীন আওয়ামী লীগ সেই পর্যবেণের তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকার বহালের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। সরকারপ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বিরোধীপ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনড় থাকায় দেশব্যাপী চরম অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। সরকারের দমন-পীড়নসহ রাজনৈতিক হানাহানিতে কয়েক শ’ মানুষ প্রাণ হারায়। জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর আহ্বান ও নানা চাপ সত্ত্বেও কোনো পই সিদ্ধান্ত ও আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। পরে জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় সংলাপে সম্মত হয় উভয়প। সেখানেও কেউ কাউকে ছাড় না দিলে কোনো ধরনের সমঝোতা সম্ভব হয়নি। বিএনপি জোট ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহতের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে ওই দিন হরতাল আর সহিংসতার মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

সহিংসতা, কেন্দ্র পোড়ানো, কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপার ও বাক্স ছিনতাই, ভাঙচুর, নির্বাচনী কর্মকর্তা হত্যা, মারধর এবং পুলিশের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারির ওই একতরফা নির্বাচন। এতে ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। ফাঁকা কেন্দ্রে ছিল জালভোটের মহোৎসব। ওই দিন সারা দেশে নিরাপত্তাবাহিনীর প্রায় সাড়ে চার লাখ সদস্যের উপস্থিতিতে ১১ জেলায় সহিংসতায় নিহত হয় ১৯ জন। এর মধ্যে ১৫ জনই মারা যায় পুলিশের গুলিতে। নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও ওই নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এর আগে ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে মারা গেছে ১২৩ জন। ভোটকেকেন্দ্র করে এত বিপুল মানুষের প্রাণহানি এর আগে দেখা যায়নি।
ভোটের আগের দিন আগুনে পুড়েছে ১১১টি ভোটকেন্দ্র। নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনতাই হয়েছে, কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে নির্বাচনী কর্মকর্তাকে। ভোটের দিনও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন নির্বাচনী কর্মকর্তা। ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা হয়েছে ৬৯৭ কেন্দ্রে। ৩৬টি আসনের ৫৩৯টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।
এর আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান ১৫৩ জন, যা নিয়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থাও বিস্ময় প্রকাশ করে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/282367