এমপিওভুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নন-এমপিও শিক্ষকদের আমরণ অনশন অব্যাহত রয়েছে
৪ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১:০২

এমপিওভুক্তির সুনির্দিষ্ট ঘোষণা চান অনশনরত শিক্ষকরা

সরকারের কাছ থেকে এমপিওভুক্তির সুনির্দিষ্ট ঘোষণা চান জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে চারদিন যাবত অনশনে থাকা নন এমপিও শিক্ষকরা। গতকাল বুধবার টানা চতুর্থ দিনের মতো আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করেন এসব শিক্ষক-কর্মচারীরা। দাবি আদায়ে প্রেস ক্লাবের সামনে সহস্রাধিক শিক্ষক-কর্মচারী আমরণ অনশন করছেন।

গত কয়েকদিন ধরে কনকনে শীতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে আছেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা। সরকারে পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত মেলেনি কার্যকর সাড়া। সাতটা বছর গত হয়েছে শুধু এই আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিতে। আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন এমপিও ভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক শফিকুল ইসলাম ও অমিতাভ রায়। শফিকুল ইসলামের বৃদ্ধ বাবা অসুস্থ। চিকিৎসা করাতে নেই ছেলের পকেটে টাকা। ইতিমধ্যে চাকরির বয়স চার বছর। এখনো বেতনের মুখ দেখেননি। অসুস্থ বাবার মুখে চেয়ে থাকা ছাড়া যেন কিছুই করার নেই শিক্ষক ছেলের। শফিকুল প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা নাকি মধ্যম আয়ের দেশ। শুনেছি- রাষ্ট্রপতি শিক্ষক দেখে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান। তাহলে কেন আমরা এতোদিন রাস্তায় ঘুমাব?

পাশে বসে থাকা আরেক শিক্ষক অমিতাভ রায় বলেন, দেশ কিভাবে উন্নত হবে, শিক্ষক যদি ঘুমায় রাস্তায়? রাজা-বাদশার আমল থেকে শিক্ষকদের সম্মান দিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু এখন আর শিক্ষকদের কেউ সম্মান করে না। আগে সবাই মাস্টার মশাই বলতেন, এখন মাস্টর বলে ব্যঙ্গ করেন। এই শিক্ষকের ভাষ্য, গ্রামের শিক্ষকদের পকেটে টাকা থাকে না। তবুও সমাজে তাল মিলিয়ে তাদের চলতে হচ্ছে। পেটে ভাত দিয়ে নয়, ভালো পোশাক পরে সম্মান নিতে হয় শিক্ষকদের।

টানা চার দিন অনশনে থাকা শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন ২৬ ডিসেম্বর থেকে। প্রায় চার হাজার শিক্ষক রাস্তায় ঘুমাচ্ছেন। তাহলে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকের মূল্য কোথায় থাকবে বলেন ঝর্ণা রানি নামের এক শিক্ষিকা। এখানে টয়লেটে সমস্যা। গোসলের ব্যবস্থা নেই। শিশু সন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে এমপিওভুক্তির আসায় আন্দোলনে নেমেছেন এই শিক্ষিকা।

এদিকে এমপিওভুক্তির দাবিতে অনশনের চতুর্থ দিনে নন এএমপিও শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার এবং সাধারণ সম্পাদক বিনয় ভূষণ রায়সহ অর্ধ শতাধিক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
শিক্ষকরা জানান, তাদের আমরণ অনশনের চতুর্থ দিনে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ৫৬ শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের অনেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। আবার অনেকে চিকিৎসা নিয়ে আবার অনশনে যোগ দিয়েছে। তবে অসুস্থ হলেও কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে এখনও অটল শিক্ষকরা। অনশন থেকে ফেরাতে আশ্বাস নিয়ে আশা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে মঙ্গলবারই ফিরিয়ে দিয়েছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, এবার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা অথবা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস না পেলে তারা বাড়ি ফিরে যাবেন না।

প্রসঙ্গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এসে নীতিমালা অনুসারেই নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করার আশ্বাস দেন। তবে তিনি নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা দেননি। এ কারণে আমরণ অনশনে থাকা শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষামন্ত্রীর এই আশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

নন এএমপিও শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার অসুস্থ হয়ে স্যালাইন লাগানোয় এখন মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাশিদুল ইসলাম রাশেদ। তিনি বলেন, আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন চলবে। আমরা শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি। তার আশ্বাসে আমরা আশ্বস্ত হই নাই। কারণ এ ধরনের আশ্বাস তিনি আগেও দিয়েছেন। গতকাল দুপুরের আগে আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন শিক্ষকদের আরেক নেতা বিনয় ভূষণ রায়। তার অবস্থা গুরুতর হওয়ার প্রেক্ষিতে খবর দেয়া হয় অ্যাম্বুলেন্সকে। তাকেও হাসপাতালে পাঠানো হয়।

শিক্ষকরা জানান সারা দেশের সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্যের ভাগ্য গড়তে শ্রম দিলেও নিজের সন্তান আর পরিবারের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের। সরকার থেকে অর্থ না পাওয়ায় অল্প কিছু বেতন বা ক্ষেত্র বিশেষ বিনা পয়সায় পড়াতে হচ্ছে তাদের। কেউ কেউ জানিয়েছেন, ১৮ বছর চাকরি করেও এক টাকা বেতন পাচ্ছেন না তারা।
অনশনের সমন্বয়কারী আরেক শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, এ পর্যন্ত ৫০ জানের বেশি অসুস্থ হয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই এখানে স্যালাইন নিয়ে শুয়ে আছে। যত অসুস্থ হচ্ছে, অনশন তত বেগবান হচ্ছে। আমরা খবর পেয়েছি, আজ সারা দিনে আরো অনেক শিক্ষক এসে যোগ দেবেন অনশনে।

গতকাল সকালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি জানান লেখক-কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, সরকারের টাকার অভাব নেই, অভাব আছে আন্তরিকতার। প্রতিদিন বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে, লুটেরারা লুট করছে। এগুলো বন্ধ করুন। সেই টাকা মানুষ গড়ার কারিগরকে দিন। আজ দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষকদের এখন শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা ছিল; কিন্তু তাঁরা আছেন রাস্তায়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ আরো বলেন, সরকারকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। আর এই অনশন থেকে যদি কোনো শিক্ষক মারা যান, তবে এর দায় সরকারের নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, আপনি শিক্ষকদের দিতে তাকান।

আমরণ অনশনে থাকা আরো অনেক শিক্ষক জানান, তাঁদের আর কোনো উপায় খোলা নেই সামনে। তারা তাদের দাবি পূরণ করেই কেবল অনশন ভাঙবেন। এর আগে তারা একটুও নড়বেন না।

বাংলাদেশে সব শেষ ২০১০ সালে এমপিওভুক্তি করা হয় এক হাজার ৬২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। এরপর আর অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এই সুবিধার আওতায় আনা যায়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী দেশের বাইরে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি দেশে ফিরলে অর্থের সংস্থান করবেন। এমপিও আওতায় আনা হলে শিক্ষকদের মূল বেতনের শতভাগ দেয় সরকার। আর সঙ্গে কিছু ভাতাও পাওয়া যায়। এর সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু টাকা পাওয়া গেলে সংসার চালিয়ে নেয়া যায়।

আবার এমপিও সুবিধার বাইরে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায় হওয়ায় তাদের ছাত্র সংখ্যা এবং আয়ও কম। ফলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদেরকে সেভাবে বেতন সহায়তা দিতে পারে না।

একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী এমপিও সুবিধার বাইরে থাকা শিক্ষকদেরকে এই সুবিধার আওতায় আনতে হলে বছরে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা লাগবে। জাতীয় বাজেট চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বাড়তি এই টাকার যোগান দেয়া কঠিন হবে না বলে দাবি করছেন শিক্ষক নেতারা।

http://www.dailysangram.com/post/313861