৪ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৮

মানবজাতির ভবিষ্যৎ বিপর্যয়

-ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ

সৃষ্টির প্রথম থেকেই জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য মানুষ বিভিন্ন পন্থা, যন্ত্রপাতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবনধারণপদ্ধতির উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে থাকে। ধীরে ধীরে ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজজীবন, গোত্রজীবন ও জাতিজীবন ধারার প্রকার, পদ্ধতি ও তার প্রসার নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বিশ্বায়নের দিকে প্রচার ও প্রসার লাভ করে বর্তমান বিশ্বের জীবনে বিস্তৃত হয়ে পড়ে।

জীবনধারণের উন্নতির পথে উন্নত যন্ত্রপাতি ও শিল্পপ্রযুক্তি ইত্যাদির আবিষ্কার ও তার প্রয়োগ এবং ব্যবহার দৈনন্দিন বিস্তার লাভ করছে। মানুষকে বিধাতা অনেক গুণের অধিকারী করেছেন। আবার একই মানুষের হৃদয়ে অনেক দোষের ভাণ্ডারও রেখেছেন। বিশেষ করে রিপুর প্রভাবে (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ অর্থাৎ অহঙ্কার, মাৎসর্য অর্থাৎ পরশ্রীকাতরতা), বিবিধ দোষের কাজ, অপরের ক্ষতিসাধন, এমনকি জীবন হনন, নির্যাতন, নারীর শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, গণধর্ষণ করে থাকে। একজন ব্যক্তি, এক জাতি, অপর এক গোত্র, জাতি অথবা সারা বিশ্বের ক্ষতি সাধন করতে পারে।

যুগে যুগে অনেক সভ্যতা উন্নতির শিখরে উঠেছে। শিক্ষাদীক্ষা, শিল্প, কারু, ভাস্কর্য, সামরিক শক্তি ইত্যাদিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে কিন্তু নিজেদের ভুলের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাদের স্মৃতি রয়েছে, কিন্তু নিজেরা বিলীন হয়ে গেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ হয়েছেÑ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল। এই দুই বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং অবর্ণনীয় দুর্ভোগ মানবজাতিকে পোহাতে হয়েছে। বর্তমানে যেসব পরাশক্তি দেশ আণবিক বোমাসহ যেভাবে অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছে, তাদের মধ্যে কারো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মহা দুর্ঘটনা (Catastrophic Consequence) হয়ে মানবসভ্যতার চরম বিপর্যয় হতে পারে।

মনে হয় মানুষ ইতিহাস থেকে তথ্য পায়, কিন্তু কিছু শেখে না। ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্ব জ্ঞানবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আণবিক শক্তিবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি (ইনফরমেশন টেকনোলজি, অর্থাৎ আইটি) মহাকাশ বিজ্ঞান ইত্যাদিতে এত উন্নতির শিখরে উঠেছে যে, বিস্ময়ে অবাক হতে হয়। অতি আনন্দের বিষয় যে, বিধাতা মানুষকে এত মেধা দিয়েছেন।

কিন্তু মানুষের মন রিপুর দাস। একই হৃদয়ে ভালো-মন্দের কারখানা, শুভ-অশুভের খেলাঘর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহার করে ব্যাপক আকারে মানবজাতির অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করতে পারে। সাইবার হ্যাকিং করে এক ব্যক্তি অথবা এক দেশ আরেক দেশকে কার্যত পঙ্গু করে দিতে পারে। যুদ্ধাস্ত্র, বিশেষ করে আণবিক বোমা, ব্যালিস্টিক মিসাইল ক্ষেপণ করে এক দেশ অপর দেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে। মূলত আণবিক যুদ্ধে কোনো দেশই এককভাবে জয়ী হবে না। বরং সব দেশই একসাথে অপূরণীয় ক্ষতির কবলে পতিত হবে। নিরীহ মানুষ তেজস্ক্রিয় পদার্থের (radioactive fallout) কারণে অপূরণীয় স্বাস্থ্যের ক্ষতি ভোগ করবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, বিগত ৬০ বছরে উন্নত দেশগুলো তাদের কমার্শিয়াল এবং নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য (consumer goods) উন্নয়নশীল দেশে রফতানির বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। অর্থাৎ উন্নত দেশগুলোর জীবনধারার মান (standard) উন্নয়নশীল দেশে রফতানি করছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো তা লুফে নিচ্ছে। অথচ উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর জীবনের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অর্থনৈতিকভাবে বাস করার যোগ্যতায় আসেনি। এ কারণে বিগত ৬০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক দুর্নীতি ভীষণ আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা সুযোগ ও ক্ষমতার অধিকারী তারাই রাতারাতি ধনী হয়েছে এবং যারা বঞ্চিত তারা আরো দরিদ্র হয়েছে। স্বল্পসংখ্যক সুযোগধারীদের কাছে বস্তুত সব অর্থসম্পদ, তাই তারা গরিবের অস্থির ওপর রাজকীয় জীবনযাপন করছে। সারা বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই দুরবস্থা চলেছে। তাই পৃথিবীতে অশান্তির মাত্রা বেড়েই চলেছে এবং সব দেশে অশান্তি বেড়েই চলেছে।

অন্য দিকে, আইটির ব্যবহারে এখন ছোট-বড় সবাই মোবাইল, ল্যাপটপ ব্যবহার করে ফেসবুক নিয়ে এমন মশগুল থাকে যে, একই বাসায় একই সোফায় বসে কেবল ফেসবুকে নিজেকে এমনভাবে ডুবিয়ে রাখে যে, কেউ কারো সাথে কথাবার্তা বা কোনো বিষয়ে আলোচনা, এমনকি তর্ক-বিতর্ক কিছু করে না। দেখা যায় ছোট শিশুকে মা খাওয়াচ্ছে; আর সে মোবাইল টিপছে, সে জানে না কী খাচ্ছে। কাসরুমে পেছনের সারিতে বসে শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে মগ্ন থাকে। ফেসবুক আইডি ব্যবহারকারী অপর সবার কাছ থেকে নিজেকে একাকিত্বে (individual isolation) সরিয়ে রাখতে পছন্দ করে। এভাবে সব মানুষ, বিশেষ করে তরুণসমাজের মেন্টাল ফ্যাকালটি, অর্থাৎ মেধার বিকাশ হয় না। যেসব খারাপ জিনিস, বিশেষ করে যৌনবিকৃতির যত আকর্ষণীয় ছবি অসাধু ব্যক্তিরা আইডিতে ছেড়ে দেয়, সেগুলোর আকর্ষণে মশগুল থাকে এবং বিপথে নিজেদের ধাবিত করে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখন তরুণসমাজ খারাপ পথে ধাবিত হচ্ছে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, জঙ্গি হামলা, খুনখারাবি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে। পরাশক্তি দেশগুলোতেও এখন অশান্তি, ভীতি, হিংসাবিদ্বেষ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

আরেকটি বিষয় মানবজাতির মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটি হলো- খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত কেমিক্যালসের (টক্সিক কেমিক্যালস) ব্যবহার। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত লাভের জন্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিষাক্ত কেমিক্যাল খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করে। ভেজাল খাদ্য রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুড ও বারগুলোতে প্রচুর বিক্রি করে। বিশেষ করে তরুণসমাজ, ছাত্রছাত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় বিনা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করে। এ কারণে অসুখ-বিসুখ বেড়েই চলেছে। মানবদেহে বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো যেমন- লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র, প্যানক্রিয়াস ও অন্যান্য অরগান নষ্ট হচ্ছে। ধীরে ধীরে মানবজাতি অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে স্বাস্থ্যগতভাবে ধ্বংসের মুখে চলেছে।

আরো একটি বিষয় মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের কারণ হলো পরিবেশ দূষণ। বিগত ৬০ বছরে দ্রুতগতি শিল্পায়ন, জীবনধারার নবায়ন, বিত্তশালীদের আড়ম্বর নেশা, পেট্রোলিয়ামচালিত যানবাহন ইত্যাদির কারণে যেসব শক্ত ((solid)), জলীয় ও বায়বীয় বর্জ্য পরিবেশে নিক্ষেপ হয়ে আসছে, সেগুলোর কারণে বায়ুমণ্ডল, জলীয় পরিমণ্ডল এবং ভূমণ্ডল সীমাহীন দূষিত হয়ে আসছে। লাখ লাখ বিমানের বিষাক্ত ধোঁয়া, কোটি কোটি যান্ত্রিক যানের বিষাক্ত ধোঁয়া, সীমাহীন শিল্পকারখানার শক্ত জলীয় ও বায়বীয় বর্জ্য পরিবেশ মাত্রাতিরিক্ত দূষিত করে চলেছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফ ক্যাপ (ice cap) পড়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে এখন নিম্নতলদেশ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব দূষণের ফলে মানুষের রোগজড়া বেড়েই চলেছে। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণী দূষণের শিকার হচ্ছে, যা নির্ণয় করা সহজ নয়। এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ না করলে সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন পৃথিবীর প্রাণিকুলের বিপর্যয়, এমনকি ধ্বংস চলে আসবে।

সব মিলে দেখা যায়, বর্তমান সভ্যতা মানবজীবনের সব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে আরো অনেক বেশি বাড়িয়ে তুলেছে। বর্তমান সভ্যতা উন্নতির দিকে দ্রুত দৌড়াচ্ছে। কিন্তু মনে হয়, এই দৌড়ানো মানবজাতির বিপর্যয় বয়ে আনবে, শান্তি নয়। ১৫ বছর আগে (২০০২ সালে) রোটারি কাবে এ বিষয়ে এক বক্তৃতায় বলেছিলাম, ''The Present civilization has been trying to find solution to all human problems, but its abuse has created more problems to humanity than solutions. This civilization is running fast to meet a sad end.'' আমার ভয় হচ্ছে যে, বর্তমান সভ্যতা নিজেদের উন্নতির অপব্যবহারের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পতিত হতে পারে।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত, ভাষাসৈনিক, পরমাণুবিজ্ঞানী, অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, জাতিসঙ্ঘ আন্তর্জাতিক
আণবিক শক্তি অ্যাজেন্সি, ভিয়েনা

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/281960