৩ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:১৫

‘দাবির মিছিলে’ পেশাজীবীরা

৩০ দফা দাবি নিয়ে সোচ্চার ১৭ সংগঠন * সরকারকে অস্থিতিশীল ও দুর্বল করতেই এসব আন্দোলন। এর পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে : অর্থ প্রতিমন্ত্রী

প্রত্যেক সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে বিভিন্ন পেশাজীবী তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। দাবি আদায়ে অতীতে কোনো কোনো সংগঠন সফলও হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও সোচ্চার হয়েছে বিভিন্ন পেশার ১৭টি সংগঠন। এবার তারা হাজির হয়েছেন পেশাসংশ্লিষ্ট ৩০টি দাবি নিয়ে। এসব দাবি-দাওয়া আদায়ে কোনো কোনো সংগঠন রাস্তায় নেমে এসেছে। কেউ কেউ পালন করছে ধর্মঘট ও কর্মবিরতি। এমনকি আমরণ অনশন অব্যাহত রেখেছে কোনো কোনো সংগঠন। আবার কেউ নিজ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি-দাওয়া নিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা সাধ্য অনুযায়ী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তবে এখনও পর্যন্ত আসেনি তেমন কোনো ইতিবাচক ফল।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশঙ্কা সরকারকে অস্থিতিশীল এবং দুর্বল করতেই এসব আন্দোলন করা হচ্ছে। এর পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে। এমনকি পেশাজীবীদের আন্দোলনে ফায়দা লুটতে পারে সরকারবিরোধীসহ স্বার্থান্বেষী মহল। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘এ ধরনের আন্দোলন আমাদের দেশে এখন ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সবাই চায় মেয়াদের শেষ সময়ে সরকারের ওপর আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে। সরকারও ভোটের জন্য ব্যস্ত। ফলে সরকারের দিক থেকেও ক্ষেত্রবিশেষ তেমন কোনো যাচাই-বাছাই বা গুণগত মান না দেখেই ভোটের প্রতি দৃষ্টি রেখে অনেক দাবি মেনে নেয়। অতীতেও এ ধরনের নজির রয়েছে।’
বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা রাজনীতির মাঠে এক রকম নিষ্ক্রিয় থাকলেও সরকারের মেয়াদের শেষ বছরের শুরুতেই রাজপথে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠন। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের দাবি আদায়ের চাপে রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। বেতন বৈষম্য দূর ও গ্রেড পরিবর্তনের দাবিতে কয়েকদিন মাঠে ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। তাদের কর্মসূচি শেষ না হতেই মাঠে নামে এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন। এমপিওভুক্তির দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ নিয়ে আশ্বাস দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা। তাদের ভাষ্য, ‘বহুবার আমাদের আশ্বাস দেয়া ও সময় নেয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। আমরা এখন আর শিক্ষামন্ত্রী বা কারও আশ্বাস নয়, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’ মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনরত নন-এমপিও শিক্ষকরা এসব কথা বলেন।
তাদের পাশাপাশি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি। প্রায় অভিন্ন দাবিতে মাঠে রয়েছে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ফোরাম। সরকারি কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা, পেনশনসহ সব সরকারি সুযোগ-সুবিধার দাবিতে এখনও আন্দোলনে রয়েছে বাংলাদেশ পৌরসভা কর্মকর্তা-কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন। একইভাবে আন্দোলনে রয়েছে বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ সেক্রেটারি সমিতি এবং বাংলাদেশ গ্রামপুলিশ কর্মচারী ইউনিয়ন। পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি চাকরি জাতীয়করণ ও ১৪তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীতকরণ। আর গ্রামপুলিশ কর্মচারী ইউনিয়নের দাবি, তাদের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী মর্যাদা দিতে হবে। পাশাপাশি কর্মচারীদের রেশনসহ কল্যাণ তহবিলে এক কোটি টাকা প্রদান করতে হবে। জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), হেলথ টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, স্বাস্থ্য বিভাগীয় মাঠ কর্মচারী সমিতি এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চুক্তিভিত্তিক মিটার রিডার মেসেঞ্জার ঐক্য পরিষদ। এছাড়া চার দফা দাবিতে স্বাস্থ্য সহকারীদের লাগাতার ধর্মঘট কর্মসূচি দু’দিনের মাথায় স্থগিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে বৈঠকের পর তারা কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করেন। বৈঠকে ধর্মঘটকারীদের দাবি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও (পিও) ১০ম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে উন্নীতকরণসহ সচিবালয় ভাতার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে। দাবি-দাওয়া জানাতে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে বাংলাদেশ সচিবালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) লিয়াজোঁ কমিটিসহ বাংলাদেশ সচিবালয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা আবেদন করেছেন। সাক্ষাতের পর প্রয়োজনে তারাও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। এছাড়া আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ প্রথা বাতিল, পেনশন আগের মতো বহাল, যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি ও ৫০ শতাংশ পোষ্য কোটা চালুর দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে বাংলাদেশ চতুর্থ শ্রেণী সরকারি কর্মচারী সমিতি (১৬-২০তম গ্রেড)। এর সঙ্গে ৬০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা, রেশন প্রদান, পদোন্নতিসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ। পাশাপাশি বকেয়া মজুরি প্রদানসহ ১১ দফা দাবিতে খুলনার ৯টি পাটকলসহ দেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করছেন। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ পরিষদের ডাকে এ ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। দাবি আদায় না হলে ৫ জানুয়ারি ঢাকায় বৈঠক করে পরবর্তী সময়ে নতুন কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে নেতারা জানিয়েছেন।

পেশাজীবীদের আন্দোলনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র দেখছেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান। এ প্রসঙ্গে তিনি যুগান্তরকে বলেন, সরকার দুর্বল হয়ে গেছে- এই মনে করে এসব আন্দোলন করছে। তাদের দাবি বাস্তবায়ন করতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এসব তারা বুঝে বা না বুঝে এ আন্দোলন করছে। সরকার বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করেছে, তা এখনও দু’বছর হয়নি। এরপরও আবার বেতন নিয়ে আন্দোলন করছে। দিনের পর দিন এসব শিক্ষক শহরে থাকছেন। স্কুলে যাচ্ছেন না। স্কুলে গেলে শিক্ষকদের পাওয়া যায় না। এসব আন্দোলনকারীর পেছনে ইন্ধন জোগানের জন্য কতিপয় লোকজন আছে। কিছু ধান্দাবাজ লোক আছে। উচ্চবিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক জীবনে ঢাকার বাইরে যান না। সরকারকে অস্থিতিশীল ও দুর্বল করতেই এসব আন্দোলন করা হচ্ছে। এর পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার যুগান্তরকে বলেন, ২০১৫ সালের বেতন স্কেলের পর বেতন বাড়ানোর দাবি অযৌক্তিক। বেতন বাড়ানোর দুই বছর পর জাতীয়করণ, বেতন বৈষম্য ও গ্রেড পরিবর্তনের নামে সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারপরও কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে বিদ্যালয়ে তালা ঝুলানোর হুমকি দিচ্ছেন। সরকারের শেষ বছর এসে এ ধরনের আন্দোলন কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এমন মন্তব্য মানতে রাজি নন আন্দোলনকারী নেতারা। তাদের মতে, বছরের পর বছর আমাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন আকাশছোঁয়া। সারা জীবন একই পদে কাজ করে অবসরে যেতে হয়। আর এর প্রতিকার চাইলেই সেখানে সরকারবিরোধী আখ্যা দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করে দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে আন্দোলনরত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের প্রতি বহুদিন ধরে অবিচার করা হচ্ছে। যখনই ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামি, তখনই এসব সরকারবিরোধী তকমা দিয়ে আন্দোলন ভণ্ডুল করে দেয়া হয়। সরকার আমাদের ব্যাপারে খোঁজ নিক। আমি আমার এলাকার একটি কলেজের ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ভিপি ছিলাম। এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। আমরা যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছি, তাদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী।

আউটসোর্সিং প্রথা বাতিলের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ চতুর্থ শ্রেণী সরকারি কর্মচারী সমিতির (১৬-২০ গ্রেড) সাধারণ সম্পাদক আবু সায়েম খান যুগান্তরকে বলেন, এটা আমাদের অস্তিত্বের বিষয়। আমাদের চাকরির সুযোগ না বাড়িয়ে চুক্তি ভিত্তিতে লোকবল নিয়োগ করবে, তা তো হতে পারে না। আর এটা বাতিলের দাবি জানালে সরকারকে বেকায়দায় ফেলানো হবে? এসব ঠিক নয়।

বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ সেক্রেটারি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপদেষ্টা আসাদুজ্জামান আসাদ যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দাবির সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক মতলব নেই। আমাদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে। ১৪তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করতে হবে। এটা আমাদের অধিকার। এখানে কিসের ষড়যন্ত্র। এসব অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন বাংলাদেশ গ্রামপুলিশ কর্মচারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/2228