৩ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:১০

আসামের নাগরিক শনাক্তকরণ একটি বৃথা প্রক্রিয়া

আসামে নাগরিকত্ব নির্ধারণ ও অবৈধ অভিবাসী শনাক্তকরণ একটি বৃথা প্রক্রিয়া। এমন মন্তব্য করে ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়ান নিউজ (ডব্লিউআইওএন)-এ একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এটি লিখেছেন সুরাজ গগৈ। ২রা জানুয়ারি প্রকাশিত ওই মন্তব্য প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, নাগরিকত্ব নবায়নের জন্য প্রণীত ন্যাশনাল রেজিস্ট্রি অফ সিটিজেনস-এর (এনআরসি) নিজস্ব ইতিহাস আছে। ওই ইতিহাস ঔপনিবেশিক পরবর্তী আসামের পরিচয় ও রাজনীতিকে এর নিজস্ব ভাষা দিয়েছে। এই নিবন্ধের সৃষ্টি একধরনের অসম জাতীয়তার মধ্যে গ্রথিত।
যেই জাতীয়তা অপর একটি শক্ত, পরিচিত শত্রুর উত্থান ঘটিয়েছে। সেই শত্রুর নাম- বাংলাদেশি। এই শত্রুর উত্থান ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আঞ্চলিক ও পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির একটি নজির স্থাপন করেছে। আর এই অঞ্চলজুড়ে বাংলাদেশিরা পরিণত হয়েছে ভিনদেশি ও অবাঞ্ছিত সহজাত টার্গেটে।

১৯৫১ সালের পর প্রথমবারের মতো এনআরসি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর মঞ্চ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। রাজ্যটির জনগণ নতুন বছরের শুরুতে নিজ নিজ এলাকার নিকটবর্তী সেবা কেন্দ্রগুলোতে ছুটে গেছে। সেখানে এনআরসি ঘোষণার প্রভাব ব্যাপক। আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে চারদিকে মোতায়েনরত ছিল সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী, রাষ্ট্রীয় পুলিশসহ অসংখ্য নিরাপত্তাকর্মী। এই ঘোষণার মাধ্যমে আসামে বিদেশিদের বিরুদ্ধে কিছু উত্তপ্ত স্মৃতিও জাগিয়ে তুলেছে। ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি দাবি করেছে, অবশেষে তারা প্রত্যেক অসমীর স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে। ৮৫৫ জন শহীদের মৃত্যু সার্থক করে তুলেছে। কেননা, এনআরসি হচ্ছে আসামকে বাংলাদেশি মুক্ত করার পথে একটি বিশাল পদক্ষেপ।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে আসাম কর্তৃপক্ষ ১লা জানুয়ারি এনআরসি’র প্রথম খসড়া প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত খসড়া অনুসারে, ৩ কোটি ২৯ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ আবেদনকারীকে ভারতের বৈধ নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বলেন, বাদবাকিরা আবেদনের বিভিন্ন পর্যায়ে আছেন। কারো নাম তালিকায় না থাকলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল শৈলেশ জানিয়েছেন, যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব অপর একটি খসড়া প্রকাশ করা হবে। তাতে ২৯ লাখ বিবাহিত নারী ও বিয়ের পর দেশ অভিবাসন করে এসেছেন এমন লোকদের নাম থাকবে।

এনআরসি’র প্রথম ধাপ হালনাগাদ করা হয় ১৯৫১ সালে। তাতে একই বছর সংঘটিত আদমশুমারির পরপরই রাজ্যটিতে ৮০ লাখ নাগরিকের নাম নথিভুক্ত করা হয়। এইবারের পরিচয় যাচাইকরণ প্রক্রিয়ায় দুই সেট তথ্য মূল ভূমিকা পালন করেছে- ১৯৫১ সালের এনআরসি ডাটা ও ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত হওয়া নির্বাচনী তালিকা। এই দুই সেট তথ্য একনামে লেগেসি ডাটা নামে পরিচিত। যেই তথ্য রাজ্যটিকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। আর এখন সেখানকার মানুষ অঞ্চলটিতে তাদের বসবাসের বৈধতা প্রমাণ করার জন্য ওই একখণ্ড কাগজ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হচ্ছে।

এনআরসি’র বিভিন্ন পর্যায়ের প্রারম্ভিক দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে, এটি খুবই পুঙ্খানুপুঙ্খ, দীর্ঘ ও একটি ভুয়া ডকুমেন্টেশন (নথিভুক্তকরণ) প্রক্রিয়া। এর রাজনৈতিক তাৎপর্যতা লুকিয়ে আছে অসমীদের মনে আসাম থেকে ‘কথিত’ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর উত্তাল তাড়না ও অস্থিরতায়। এই নাগরিক শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া মূলত, রাজ্যটি থেকে ‘ভিনদেশি’ মানুষগুলোকে বের করে দেয়ার একটি প্রক্রিয়া। যেই ভিনদেশি মানুষগুলো রাজ্যজুড়ে ঘৃণিত এবং যাদের রাজ্যে জনসাধারণ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।
সামনে যা ঘটতে চলেছে
নাগরিক শনাক্তকরণের এই প্রক্রিয়ার পরিচালনা নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রক্রিয়া শেষে অবৈধ বা সন্দেহভাজন প্রমাণিত হলে ওইসব কথিত ‘ভিনদেশিদের’ কি হবে? এই প্রক্রিয়ার পরিণতি কি? বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এরকম নাগরিক ফেরত পাঠানো নিয়ে কোনো চুক্তি করা হয়নি। যার মানে হচ্ছে, এই যাচাইকরণ প্রক্রিয়া অচিরেই বিশাল বাধার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।

অবৈধ অভিবাসী (ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নিশ্চিত করা) আইনের আওতায় এইসব কথিত বিদেশিদের ফেরত পাঠানোর একটি উপায় ছিল। কিন্তু ২০০৫ সালে সর্বানন্দ সোনোয়াল বনাম ভারতীয় জোট মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ওই আইন বাতিল করে দেয়। বিদেশিদের আসাম থেকে সরানোর জন্য নতুন একটি পদক্ষেপের কথা শোনা যাচ্ছে। তা হচ্ছে, এনআরসি প্রক্রিয়ায় অবৈধ হিসেবে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দেয়া হবে। তবে কথিত বাংলাদেশিদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে, ভারতের সকল বিরোধী দলগুলো এমন পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে, এরকম বিভেদজনক ও পদক্ষেপের আহামরি প্রয়োজন নেই। আসামের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থমন্ত্রী হেমান্ত বিশ্বাস শর্মা প্রকাশ্যেই বলেছেন যে, অবৈধ অভিবাসীদের যেভাবেই হোক ফেরত পাঠানো হবে। তিনি এমনকি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চান। এদিকে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজেন গোহাইন দাবি করেন, বাংলাদেশি হিন্দুদের আসামে পুনর্বাসন করা হলে আসাম রাজ্যের ও রাজ্যের পরিচয়ের কোনো ক্ষতি হবে না।

এই ইস্যুতে বহিরাগতদের বিষয়েই বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। আর এই সুযোগে রাজ্যের কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে মাতৃকালীন মৃত্যুর মতো বহু গুরুতর সমস্যাগুলো এখন আড়ালে পড়ে গেছে। এনআরসি কিছু মিশ্র দাবির ও পাল্টা দাবির একটি থলে নিয়ে হাজির হয়েছে। আর তা এই হিমশীতল শীতের মাঝখানে অনেকের জীবন বিপজ্জনক করে তুলেছে।

 

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=98882