২ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৩২

আলোচনায় ছিল হাওরে আকস্মিক বন্যা আর পাউবোর গাফিলতি

হাওরে আকস্মিক বন্যা ছিল এ বছরে প্রধান খবরের একটি। বিশেষত আকস্মিক বন্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ড তথা পাউবোর নীরবতা সবাইকে হতবাক করে। অবশ্য মিডিয়ায় বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়ায় সুশীলসমাজ এমনকি শীর্ষ মহলে টনক নড়ে।

এপ্রিলের শুরুতে উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢল ও অতিবৃষ্টিতে বাঁধ ভেঙে বন্যার পাশাপাশি সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের সব বোরোধান পানিতে তলিয়ে যায়। ঢলে বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ২ লক্ষাধিক হেক্টর জমির বোরোধান তলিয়ে যায়। এ সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্যে বের হয়ে আসে সুনামগঞ্জ জেলার ২,২৩,০৮২ হেক্টর আবাদকৃত জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১,১৩,০০০ হেক্টর। এ ছাড়া নেত্রকোনার মাত্র একটি বাঁধ এখন পর্যন্ত টিকে আছে, বাকি সব বাঁধ ভেসে গেছে। নেত্রকোনা কিশোরগঞ্জ, সুমানগঞ্জÑ এই তিন জেলায় পানিতে ডুবে গেছে ১,৭১,১১৫ হেক্টর জমির ধান। ফলে ২ কোটি ৫ লাখ মণ ধান কৃষকের ঘরে উঠছে না। এতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। তবে ক্ষতির পরিমাণ পরে অনেক বেড়ে যায়।

পাশাপাশি বন্যার কয়েক দিন পরই পানি বিষাক্ত হওয়ায় হাওরে মাছ মরা শুরু হয়, তারপর মরতে থাকে হাঁস। হাকালুকি হাওরেই আনুমানিক ২৫ মেট্রিকটন মাছ মারা যায়। সেই সাথে ইউরেনিয়ানের কারণে পানি দূষণ হয়েছে এমন অভিযোগও ওঠে। তবে হাওর এলাকায় সরেজমিন তাৎক্ষণিক গবেষণা চালিয়ে আসা একটি প্রতিনিধিদলের প্রধান ঢাবি উদ্ভিদ বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খন্দকার সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেন হাওরে দিনের পর দিন লাখ লাখ টন সার ও বিপুল কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এসব সার ও কীটনাশক মাটিতে ও ধানগাছে লেগে থাকে। কিন্তু এবার আকস্মিক বন্যায় এসব সার ছড়িয়ে পড়ায় এক ধরনের বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর পাশাপাশি দুধধানও দায়ী এ দূষণের জন্য। দুধ বা কচি ধানগাছ মরতে শুরু করার পাশাপাশি পচেছে তাড়াতাড়ি। কারণ এই দুধধান বন্যার করাল থাবায় দ্রুত ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। আর এসব সার কীটনাশক ও দুধধান মিশে পুরো এলাকার মাটি পানি বাতাস তাড়াতাড়ি বিষাক্ত হয়ে ওঠায় এমন বিপর্যয় ঘটে।
তবে সময়মত বাঁধ নির্মাণ না করতে পারায় এ ধরনের বন্যার কবলে পড়তে হয়েছে এমন অভিযোগ বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হতে থাকে। হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্মের সংবাদ সম্মেলন করে পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরগুলো তলিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের অর্থ লোপাটকেই দায়ী করে। ‘হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার বলেন, অন্যান্য বছর ফসলহানি হলেও এবারের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি ‘ব্যতিক্রম’। তিনি বলেন, অন্যান্য বছরে হাওরে পানিতে ডুবে গেলেও ধান পাকা থাকে। আর তাই পানির তল থেকে কিছু না কিছু ধান কেটে আনা সম্ভব হয়। এবার ধানক্ষেতে থোড় পর্যন্ত আসেনি। এমন বিপর্যয় আমি কখনো দেখিনি।

হাওর অ্যাডভোকেসির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুজ্জামান জানান, তারা ১১ থেকে ১৩ মার্চ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করে বাঁধ সংস্কারের কাজে অব্যবস্থাপনা দেখেছেন। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ, বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া, অনেক বাঁধের কাজ শুরু না হওয়া, সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়া, অপ্রয়োজনীয় জায়গায় বাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও অসঙ্গতির কথা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া সুনামগঞ্জে অর্থ প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নানও বলেছেন, বাঁধ মেরামতে গাফিলতির অভিযোগ স্থানীয়দের কাছে পেয়েছেন তিনি। এমন খবরে সরকারের শীর্ষ মহলে টনক নড়ে। হাওরাঞ্চলের বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারকাজে সাথে যুক্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তিন প্রকৌশলীকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করাও হয়। তবে বছর শেষেও হাওর থেকে ভালো খবর আসেনি না। কারণ অনেক হাওর থেকে বন্যার পানি এখনো সরেনি।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/281412