১ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ২:৫৭

রাসূলের (সা.) প্রণোদনায় আসহাবে রাসূল হজরত আলী (রা.) -এর কাব্যচর্চা

-মোশাররফ হোসেন খান

রাসূল (সা.)। তিনি ছিলেন তুলনাহীন এক অসাধারণ মহামানব। ছিলেন মানুষ ও মানবতার শিক্ষক। তিনি ছিলেন শিক্ষকের শিক্ষক। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রয়াসে তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতি, মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ এক নতুন আলোকিত মাত্রা পেয়েছিল। তিনি শুধু সমাজ-সংস্কারই করেননি, বরং সমাজ-জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। আমরা বিস্মিত হই, যখন দেখি রাসূল (সা.) একই সাথে শাসক, সমরবিদ, সেনাপতি, সমাজ-সংস্কারকসহ সকল দিকে তাঁর ঐতিহাসিক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এমনই একজন মহামানব তিনি, যিনি শিল্প-সাহিত্য ও আসহাবে রাসূলের (সা.) কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন অতুলনীয় ভূমিকা। রাসূলের (সা.) প্রত্যক্ষ প্রণোদনায় সাহাবী-কবিগণ তাঁদের কাব্যচর্চার ধারা বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের রচিত সেইসব কাব্যসাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত বলেই আজও সেসব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, গবেষণা ও আলোচনা-পর্যালোচনা হয়।

রাসূলের (সা.) সাহায্য, সহযোগিতা, প্রেরণা ও উৎসাহে যেসব সাহাবী-কবির উত্থান ঘটেছিল, এবং যাঁরা কাব্যসাহিত্যে অমরতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) অন্যতম। তাঁর কাব্যসাহিত্য নিয়েই আজকের এই যৎকিঞ্চিত পর্যালোচনা। রাহমাতুল্লিল আলামীন সাইয়্যিদুল মুরসালীন খাতামুন নাবীয়্যীন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী হজরত আলী (রা.) ইবনে আবু তালিব। সুবিচারের জন্য তিনি ‘শ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক’ মর্যাদায় ভূষিত ছিলেন। সাহাবীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সশস্ত্র জিহাদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র রচনা, নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদের সাথে চুক্তিপত্র রচনা, কৃষকদের অধিকার সংরক্ষণে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলনে হজরত আলীর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল। কৃষক-শ্রমিক তথা সকল শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু ছিলেন তিনি। অনন্য মগ্নতায় তিনি নামাজ সম্পন্ন করতেন এবং আল্লাহর প্রেমে কখনো কখনো সংজ্ঞা হারাতেন। তিনি নাজিলকৃত আয়াত লিখে রাখতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা-এর.) সাথে আলোচনা করতেন। তিনি অতুলনীয় ছিলেন। অনন্য জ্ঞান প্রজ্ঞার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা-এর.) বিশেষ নৈকট্যে থেকে সূরা নাজিলের প্রেক্ষিতসহ আয়াতসমূহের অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগলাভ করেন তিনি।

মহান সাহাবী ও খলিফা হজরত আলী (রা.) আরবী সাহিত্যেও সুপ-িত ছিলেন। সশস্ত্র জিহাদসমূহে তাঁর ভূমিকা কিংবদন্তিতুল্য। তিরাশিটি সশস্ত্র জিহাদে বিজয়ী হন তিনি। বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুওয়াত লাভ করেন সোমবারে এবং হজরত আলী (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন পরদিন মঙ্গলবার। ইসলাম গ্রহণের পর সত্য অবলম্বন করে থাকা ও প্রচারের কাজে তিনি নানাভাবে নির্যাতিত হন। হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিনিধিরূপে আমানতকারীদের কাছে আমানত ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করে তাঁর নিজের বিছানায় তাঁকে রেখে যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সেখানে থেকে মারাত্মক বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমানতকারীদের আমানত ফিরিয়ে দিয়ে সপরিবারে মদীনায় হিজরত করেন। ইসলামের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ জিহাদ-বদরে তিনি বিপুল সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। উহুদের যুদ্ধে জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। বিধর্মীরা তাঁকে ঘিরে ফেললো। তিনি নিজ অবস্থান থেকে ছুটে এসে তাদের ব্যূহ ভেদ করে নবীজীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। খন্দকের সশস্ত্র জিহাদে আমির ইবনে আবদে উদ দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালে তিনি এগিয়ে যান ও সবাইকে অবাক করে তাঁর জুলফিকারে ইবনে আবদে উদকে হত্যা করেন।

খায়বারের জিহাদে কঠিন ভাগ্য পরীক্ষা। মুসলিম বাহিনীর কোনো সেনাপতি জয়ী হতে পারছিলেন না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা দেবো, যিনি আল্লাহ ও রাসূলকে অত্যধিক ভালোবাসেন এবং আল্লাহ তাঁর দ্বারা বিজয় লাভ করাবেন। তিনি কিছুতেই পশ্চাৎপদ হবেন না।’ হজরত আলীর চোখের রোগ রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর দোয়ায় মুহূর্তে নিরাময় হলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে পতাকা প্রদান করে বললেন, ‘হে আলী! পতাকা গ্রহণ করো এবং তা নিয়ে অগ্রসর হও যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করেন।’ যুদ্ধে ঢাল হাতছাড়া হয়ে গেলে তিনি দুর্গের কপাট খুলে ঢালরূপে ব্যবহার করেন এবং যুদ্ধ শেষে তা দূরে নিক্ষেপ করেন। একমাত্র তাবুক অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে মদীনা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।

তিনি ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে গঠনমূলক ভূমিকা অব্যাহত রাখেন ও প্রথম তিন খলিফার শাসনকালের পঁচিশ বছর সহযোগিতা দান করেন। তিনি হজরত উমর (রা.) -কে হিজরত হতে মুসলিম সন গণনার পরামর্শ দান করেন। হজরত উমর (রা.) বলেন, ‘আলী না হলে উমর ধ্বংস হতো।’ হিজরীর শেষ দিক থেকে ৪০ হিজরীর ১৭ রমজান পযন্ত খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পরিচালনা করেন তিনি। ২১ রমজান রাতে ৬৩ বছর বয়সে তিনি শাহাদাত লাভ করেন। রোববার রাতে তাঁকে কুফায় দাফন করাহয়।

হজরত আলীর (রা.) অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা ছিল। অধ্যাপক পি কে হিট্টি হজরত আলীকে (রা.) ‘মুসলিম সাহিত্য ও শৌর্যবীর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে মূল্যায়ন করেন।’ ঐতিহাসিক গীবন বলেন, ‘জন্ম, আত্মীয়তার বন্ধন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলীকে (রা.) এত বেশি মহিমান্বিত করেছিল যে, আরবের শূন্য সিংহাসনের দাবি করা তাঁর জন্য অযৌক্তিক ছিল না। একজন কবি, একজন দরবেশ ও একজন সৈনিকের সমন্বিত গুণাবলী তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। তাঁর বাগ্মিতা ও সাহসিকতার কাছে সব প্রতিদ্বন্দ্বীই হার মানতো। মহানবী (সা.) তাঁর কর্তব্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর এই বন্ধুর কথা মনে রেখেছিলেন। তাঁকে তিনি নিজের ভাই, প্রতিনিধি এবং দ্বিতীয় মূসার বিশ্বস্ত হারুন হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন।’

অনন্য বাগ্মিতার অধিকারী ছিলেন হজরত আলী (রা.)। জনগণের উদ্দেশে বিভিন্ন সময়ে তিনি যে ভাষণ প্রদান করেন, তার সংকলন গ্রন্থ বিখ্যাত ‘নাহযুল বালাগা।’ এতে তাঁর ধর্মীয় বিচার-বুদ্ধি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জীবনবোধ ও আল্লাহর কাছে আত্মনিবেদনের আকুতির প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর সেই ভাষণাবলী প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন ও ভাষার লালিত্যে এক অতুলনীয় সাহিত্যকর্মে রূপ গ্রহণ করেছে। আরবী ভাষার অমূল্য সম্পদ হিসেবে এ গ্রন্থ সর্বত্র, স্বীকৃত ও সম্মানিত। আরবী গদ্য ধারায় মাকামা সাহিত্যের স্থান অত্যন্ত উঁচুতে। শাশ্বত সর্বজনীন বাণীর ভিত্তিতে বক্তব্য উপস্থাপন, কালোত্তীর্ণ ভাব ও অলংকরণ, গদ্য ধারায় ছান্দিক কুশলতা ও শিল্প-শোভনতা নাহযুল বালাগার মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছে।

হজরত আলী (রা.) -কে আরবী ব্যাকরণের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানে আবুল আসওয়াদ দুয়েলী প্রথম আরবী ব্যাকরণ রচনা করেন। হজরত আলী (রা.) লিখেছেন অনেক কবিতা। পবিত্র হাদীস ও সাহিত্যের গ্রন্থাবলীতে তাঁর অনেক কবিতা পাওয়া যায়। তাঁর কবিতার বিভিন্ন সংকলনও হয়েছে। দীওয়ান-ই-আলী (রা.) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কাব্য সংকলন। মুসলিম বিশ্বে তো বটেই, এর বাইরেও এ গ্রন্থের সমাদর ব্যাপক-বিশাল। সার্বজনীন কালোত্তীর্ণ বাণী ও শিল্প সৌন্দর্যে এ গ্রন্থ কালজয়ীর ভূমিকা পালন করছে। দীওয়ান শব্দের অর্থ কাব্যগ্রন্থ, কবিতা সংকলন। বিচারালয়ও এর অর্থ হয়। এককভাবে কোনো কবির কাব্য-সমষ্টিকে বা একই গোত্রের কয়েকজনের কাব্যসংগ্রহকে দীওয়ান বলা হয়। দীওয়ান-ই-আলী (রা.) মানে আলী (রা.)-এর কাব্য সংকলন। আল্লামা শিবলী নুমানী এ গ্রন্থের মর্যাদা ও খ্যাতির ওপর মূল্যবান এক অভিমতে বলেন, ‘আরবী কাব্য সাহিত্যে মুআল্লাকা, লামিয়াত ও আধুনিক আরবীয় গদ্য ও কাব্যসাহিত্যের সুবিশাল জগতের মধ্যে দীওয়ান-ই-আলীর তুলনামূলক মূল্যায়নে এটা স্বচ্ছ হয় যে, ইসলামের অনুপম সত্য ও সুন্দরের উপস্থাপনায়, মানবীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের সৃজনশীলতায়, নশ্বর পার্থিবতার মোহের বলয় ভেঙে চিরন্তন জীবনের আহ্বান কুশলতায়, সর্বোপরি মাবুদ ও বান্দার সম্পর্ক ও নৈকট্যের জন্য অনুপম আকুতি-সমৃদ্ধ দীওয়ান-ই আলী (রা.) একই সাথে তত্ত্বসন্ধানী ও শিল্পান্বেষী মানুষের জন্য এক মূল্যবান উপহার এবং এর গতিময়তা কাল থেকে কালান্তরে, শতকের পর শতক পেরিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত দৃষ্টিকোণগত সংকীর্ণতার যূপকাষ্ঠে দীওয়ান-ই-আলী (রা.)-এর মত সার্বজনীন মানবতাবাদী বিশ্বসাহিত্যে যথাযোগ্য মূল্যায়ন ঘটেনি। খিলাফতের প্রতি বৈরী আঘাত থেকে এ সাহিতকর্মও রেহাই পায়নি। কারণ এর কবি হজরত আলী (রা.), খুলাফায়ে রাশেদীনের শেষ খলিফা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে মজলুম মানুষের মুক্তির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য-কর্ম হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় এর আহ্বান উপস্থাপিত হয়নি। মানবিক মহিমার সর্বোচ্চ ঘোষণায় দীওয়ান-ই-আলী (রা.) শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ছিল সেদিন, রয়েছে আজো এবং এর আবেদন আগামীর আবহমান মানুষের মিছিলেও শামিল থাকবে।’

হজরত আলী (রা.)-এর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সুধীমহল কমবেশি অবহিত আছেন। আরবী কাব্যক্ষেত্রে হজরত আলী (রা.-) এর অমর অবদানের মধ্যে রয়েছে আনওয়ার আল-উকূল মিন আশআরী ওয়াসিইয়ী আর-রাসূল (রাসূল প্রতিনিধির কবিতাবলী জ্ঞানপ্রদীপ)। হি. ৮৯৭,/খৃ. ১৪৯২ সনে সাদী ইবন তাজী সংকলিত এ গ্রন্থ ব্রিটিশ মিউজিয়াম (প্রথম) ৮/৫৭৭; আয়া সুফিয়া ৪২/৩৯৩৭; পাটনা ১: ৭৪৯, ১৯৫; লীডন ৫৮০; প্যারিস (প্রথম) ৩/৩০৮২; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (দ্বিতীয়) ২/১২২৪; মিউনিখ (প্রথম) ২/৪৪১; ভ্যাটিক্যান (তৃতীয়) ৩৬৫; আলীগড় ৭,১৩৪ও অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে। হি. ৮৯০/খৃ. ১৭৮৫ সনে হুসাইন ইবনে মুঈন আল-দীন-আল-মাইবুযী কতৃর্ক ফার্সি ভাষায়কৃত এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ লীডন ৫৭৯; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (প্রথম) ৫৭৯/১৬৬৫; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (দ্বিতীয়) ১: ১৯,২০; তেহরান ২: ৪/৪১৩ ইত্যাদি স্থানে পাওয়া যায়। এছাড়া অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তিত্বকৃত এর ফার্সি অনুবাদ হামবুর্গ (১,১৯১)-সংরক্ষিত রয়েছে। মূলত হজরত আলীর (রা.) কাব্য ও সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
দুই.

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবু আবারও স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, হজরত আলী (রা.) ছিলেন একজন সুবক্তা ও বিখ্যাত কবি। তাঁর কবিতার একটি ‘দীওয়ান’ আমরা পেয়ে থাকি। তাতে অনেকগুলো কবিতায় মোট ১৪০০ শ্লোক আছে। গবেষকদের ধারণা, তাঁর নামে প্রচলিত অনেকগুলো কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে তিনি যে তৎকালীন আরবী কাব্যজগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল ছিলেন এতে প-িতগণের কোনো সংশয় নেই। ‘নাহযুল বালাগা’ নামে তাঁর বক্তারৃতএকটি সংকলন আছে, যা তাঁর অতুলনীয় বাগ্মিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।

হজরত আলীর (রা.) কবিতার বিষয়বস্তু বিচিত্রধর্মী। বংশ অহমিকা, মূর্খের সাহচর্য, যুগের বিশ্বাসঘাতকতা, যুগযন্ত্রণা, দুনিয়ার মোহ, দুনিয়া থেকে আত্মরক্ষা, সহিষ্ণুতার মর্যাদা, বিপদে ধৈর্য ধারণ, দুঃখের পর সুখ, অল্পেষ্টি,দারিদ্র্যতু ও প্রাচুর্য ইত্যাদি বিষয় যেমন তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে, তেমনিভাবে সমকালীন ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, যুদ্ধের বর্ণনা, প্রিয়নবীর (সা.) সাহচর্য, তাকদীর, আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস, খোদাভীতিসহ নানা বিষয় তাতে বাক্সময় হয়ে উঠেছে। তিনি মৃত্যুর অনিবার্যতা, যৌবনের উন্মাদনা, বন্ধুত্বের রীতিনীতি, ভ্রমণের উপকারিতা, জ্ঞানের মহত্ব ও অজ্ঞতার নিচতা, মানুষের অভ্যন্তরের পশুত্ব ইত্যাদি বিষয়ের কথা যেমন বলেছেন, তেমনিভাবে প্রিয়নবীর (সা.) ও প্রিয়তমা স্ত্রী ফাতিমার (রা.) মৃত্যুতে শোকগাঁথাও রচনা করেছেন।

বংশ অহমিকা যে অসার ও ভিত্তিহীন সেকথা হজরত আলী (রা.) বলেছেন এভাবেÑ ‘আকার-আকৃতির দিক দিয়ে সকল মানুষ সমান।

তাদের পিতা আদম এবং মা হাওয়া।

মায়েরা ধারণের পাত্রস্বরূপ, আর পিতারা বংশের জন্য।

সুতরাং মানুষের গর্ব ও অহঙ্কারের যদি কিছু থেকে থাকে

তা হলো কাদা ও পানি।’

পুত্র হুসাইনকে (রা.) তিনি উপদেশ দান করেছেন এভাবেÑ

‘হে হুসাইন! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি,

তোমাকে আদব শিখাচ্ছি; মন দিয়ে শোন।

কারণ বুদ্ধিমান সেই যে শিষ্টাচারী হয়।

তোমার স্নেহশীল পিতার উপদেশ স্মরণ রাখবে,

যিনি তোমাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।

যাতে তোমার পদস্খলন না হয়।

আমার প্রিয় ছেলে!

জেনে রাখ, তোমার রুজি-রিজিক নির্ধারিত আছে।

সুতরাং উপার্জন যাই কর, সৎভাবে করবে।

অর্থ-সম্পদ উপার্জনকে তোমার পেশা বানাবে না।

বরং আল্লাহভীতিকেই তোমার উপার্জনের লক্ষ্য বানাবে।’ বুদ্ধি, জ্ঞানের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তিনি বলেছেন এভাবে

‘মানুষের জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ হলো তার বোধ ও বুদ্ধি।
তার সমতুল্য অন্য কোনো ভালো জিনিস আর নেই। 
দয়াময় আল্লাহ যদি মানুষের বৃদ্ধিপূর্ণ করে দেন
তাহলে তার নীতিনৈতিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে।
একজন যুবক মানুষের মাঝে বুদ্ধির দ্বারাই বেঁচে থাকে।
আর বুদ্ধির ওপরই তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
সুস্থ-সঠিক বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে সৌন্দর্যময় করে যদিও তার আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়।
আর স্বল্প বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে গ্লানিময় করে

যদিও বংশ মর্যাদায় সে হয় অভিজাত।’

তিনি পৃথিবীর নশ্বরতা ও নিত্যতাকে মাকড়সার জালের সাথে তুলনা করে বলেছেনÑ ‘নিশ্চয় দুনিয়া নশ্বর।

এর কোনো স্থায়িত্ব নেই।

এ দুনিয়ার উপমা হলো মাকড়সার তৈরি করা ঘর।

হে দুনিয়ার অন্বেষণকারী!

দিনের খোরাকই তোমার জন্য যথেষ্ট।

আর আমার জীবনের শপথ!

খুব শিগগির এ দুনিয়ার বুকে যারা আছে,

সবাই মারা যাবে।’

তিনি দুনিয়াকে সাপের সাথে তুলনা করেছেন এভাবে

‘দুনিয়া হলো সেই সাপের মত যে বিষ ছড়ায়;

যদিও তার দেহ নরম ও কৃশকায়।’

দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ-দুঃখে ধৈর্যহারা না হওয়ার কথা বলেছেন এভাবেÑ ‘যুগ বা কাল যদি আমাকে দুঃখ দেয় তাহলে আমি সংকল্প করেছি ধৈর্য ধরার।

আর যে বিপদ চিরস্থায়ী নয় তা খুবই সহজ ব্যাপার।

আর যুগ যদি আনন্দ দেয় তাহলে উল্লাসে আমি মাতি না।

আর যে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী তা একান্ত তুচ্ছ ব্যাপার।’

খায়বার যুদ্ধের দিন মারহাব ইহুদি তরবারি কোষমুক্ত করে নিম্নের এই শ্লোকটি আওড়াতে আওড়াতে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানায়

‘খায়বার ময়দান জানে যে, আমি মারহাব।

আমি অস্ত্রধাণকারী,

অভিজ্ঞ বীর-যখন যুদ্ধের দাবানল জ্বলে ওঠে।’

এক পর্যায়ে হজরত আলী (রা.) এই শ্লোকটি আবৃত্তি করতে করতে অসীম সাহসিকতার সাথে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন

“আমি সেই ব্যক্তি যার মা তাকে ‘হায়দার’ নাম রেখেছে।

আমি জঙ্গলের বীভৎস দৃশ্যরূপী সিংহ।

আমি শত্রু বাহিনীকে সানদারাড় পরিমাপে পরিমাপ করি।

অর্থাৎ তাদের পূর্ণরূপে হত্যা করি।”

উহুদ যুদ্ধের পর হজরত আলী (রা.) হজরত ফাতিমার (রা.) কাছে এসে বললেন, ফাতিমা! তরবারিটি রাখ। আজ এটি দিয়ে খুব যুদ্ধ করেছি। তারপর তিনি এই দু’টি শ্লোক আবৃত্তি করলেনÑ

‘হে ফাতিমা!

এই তরবারিটি রাখ যা কখনো কলঙ্কিত হয়নি।

আর আমিও ভীরু কাপুরুষ নই এবং নই নিচ।

আমার জীবনের কসম!

নবী আহমাদের সাহায্যার্থে এবং বান্দার সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞাত

প্রভুর সন্তুষ্টি বিধানে আমি এটাকে ব্যবহার করে পুরনো করে ফেলেছি।’

কবিতা সম্পর্কে হজরত আলীর (রা.) মনোভাব তাঁর একটি মূল্যবান উক্তিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেনÑ ‘কবিতা হলো একটি জাতির দাঁড়িপাল্লা (অথবা তিনি বলেছেন) কথার দাঁড়িপাল্লা।’ অর্থাৎ দাঁড়িপাল্লা দিয়ে যেমন জিনসপত্রের পরিমাপ করা হয়, তেমনি কোন জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতি, সভ্যতা, নৈতিকতা ও আদর্শের পরিমাপ করা যায় তাদের কবিতা দ্বারা। তিনি শুধু নিজে একজন উঁচু মানের কবি ছিলেন শুধু তাই নয়, বরং অন্য কবিদেরও তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তাদের কবিতার যথাযথ মূল্যায়নও করতেন। যেমনÑ একবার এক বেদুঈনতাঁর কাছে এসে কিছু সাহায্য চাইলো। তিনি তাকে একটি চাদর দান করলেন। লোকটি যাওয়ার সময় তার নিজের একটি কবিতা শোনালো। এবার হজরত আলী (রা.) তাকে আরো পঞ্চাশটি দীনার দিয়ে বললেন, শোন, চাদর হলো তোমার চাওয়ার জন্য, আর দীনারগুলো হলো তোমার কবিতার জন্য। আমি রাসূলকে (সা.) বলতে শুনেছি যে, তোমরা প্রত্যেক লোককে তার যোগ্য আসনে সমাসীন করবে।’
তিন.

রাসূল (সা.) কবি ও কবিতাকে ভালোবাসতেন। কবিকে যথাযথ মর্যাদা দিতেন। পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সহযোগিতা করতেন। অনুপ্রেরণা দান করতেন। রাসূলের (সা.) এই কর্মধারায় সাহাবীগণও অভিষিক্ত ছিলেন। হজরত আলী (রা.) কবি ও কবিতাকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি তার পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতাও করতেন। রাসূলের (সা.) প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য ও শিক্ষায় উদ্ভাসিত ছিলেন তাঁরা। যে কারণে সমরে কিংবা শান্তিতে, শাসকের দায়িত্ব পালন কালে, নেতৃত্ব প্রদান কালে; অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় তাঁরা কবি ও কবিতাকে যথাযথ সম্মান, মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে গেছেন, যা আজ এবং আগামীর জন্য এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্তস্বরূপ। সুতরাং কবি ও কবিতার যথাযোগ্য মূল্য ও মর্যাদা দেয়া সুন্নতেরই একটি বড় অধ্যায়।

বেদনার বিষয় বটে, আজকে যারা নেতৃত্বের আসীনে অধিষ্ঠিত, তাঁদের কাছে কবি ও কবিতার বিশেষ কোনো মূল্য বা মর্যাদা আছে বলে মনে হয় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিরাই নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত। এটা কোনো ক্রমেই শুভ লক্ষণ নয়। কাম্যতো নয়-ই। স্মরণ রাখা উচিত, বিশ্বাসী কবিদের কবিতা ইসলামী সমাজ গঠনে, আদর্শিক সংস্কৃৃতি বিকাশে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সবিশেষ ভূমিকাপালন করে। সুতরাং যাদের এতটা অবদান সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে,

সেই সকল কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিও ইসলামের নেতৃবৃন্দসহ সকলের সুদৃষ্টি রাখা একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন কবি ও কবিতার যথাযথ মর্যাদা ও মূল্য দেয়ার। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করার। তাহলেই বিশ্বাসী কবিতার ধারা আরও বেগবান হয়ে উঠবে। আর তাতে করে সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সবুজ চত্বর আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে।

একটি সবুজ-সুন্দর পৃথিবী ও সমাজ বিনির্মাণের জন্য কবি ও কবিতার ভূমিকা অনিঃশেষ। বিষয়টির প্রতি সকলের সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি।

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।