১ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:২৫

বিদায়ী বছরের মূল্যায়ন ও নতুন বছরে রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশা

# সরকারের কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনে রাজনৈতিক সন্ত্রাস, হত্যা, গুম, অপহরণ বেড়েছে -অধ্যাপক মুজিব
# আ’লীগ শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকতে সব আদর্শকে ধ্বংস করে দিয়েছে -মির্জা ফখরুল
# বিদায়ী বছরে নাস্তিকরা ইসলামের অবমাননা করেছে সবচেয়ে বেশি -মাওলানা আতাউল্লাহ
# নতুন বছর হবে গণতন্ত্রের বছর -মাওলানা ইসহাক
# জনগণ চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও দখলদারিত্ব মুক্ত বাংলাদেশ চায় -চরমোনাই পীর
# ষোড়শ সংশোধনী রায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছিল সরকার -মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ ইবরাহিম

নানা চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়ে ২০১৭ সাল পার হলো। ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আলোচনায় ছিল বিচারাঙ্গন। রাজনৈতিক হত্যা, গুম, অপহরণ ও গ্রেফতার চলছে ব্যাপকভাবে। ব্যাংকিং খাতে চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও নৈরাজ্যজনক অবস্থা বিরাজ করছে। এ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বিগত বছর নিয়ে জানিয়েছেন তাদের নিজস্ব মূল্যায়ন। ২০১৮ সাল নিয়ে জানিয়েছেন তাদের প্রত্যাশার কথা।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দেশবাসীকে ২০১৮ ইংরেজি নব-বর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে, “মনমরা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো। (আলে ইমরান-১৩৯)। “এখন যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও। এ তো কালের উত্থান-পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি।” .......... (আলে ইমরান-১৪০)। ২০১৭ সালের মূল্যায়ন করতে গিয়ে দৈনিক সংগ্রামকে তিনি বলেন, ২০১৭ সাল ছিল বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকারের জুলুম-নির্যাতন, রাজনৈতিক হত্যা, গুমসহ নানা আলোচিত ঘটনাবহুল। রাজনৈতিক হত্যা, গুম, অপহরণ ও গ্রেফতার চলছে ব্যাপকভাবে। গত অক্টোবর মাসের ৯ তারিখ সন্ধ্যায় সরকার ঢাকা মহানগরীর উত্তরার একটি বাড়ি থেকে জামায়াতের আমীর মকবুল আহমাদ, নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের আমীর মুহাম্মাদ শাহজাহানসহ আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে এবং ২৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও রংপুর মহানগরী জামায়াতের আমীর মাহবুবুর রহমান বেলালসহ সারা দেশে জামায়াতের বহু নেতা-কর্মীকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে। এমনকি অনেক মহিলা নেত্রী ও কর্মীকে সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে। দেশের মানুষের জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই। চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ঘুষ-দুর্নীতি ও প্রশাসনকে দলীয়করণের কারণে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। শিক্ষা মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ সম্প্রতি প্রদত্ত এক বক্তব্যে ঘুষ-দুর্নীতির কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। অর্থমন্ত্রীও ঘুষ-দুর্নীতির ভয়াবহতার কথা অকপটেই স্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনের কারণে দেশে রাজনৈতিক সন্ত্রাস, হত্যা, গুম, অপহরণ, গণগ্রেফতার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে যে, ২০১৭ সালে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার ও গুলী বিনিময়ে ১২৬ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়াও পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনের কারণে ১২ জন, গ্রেফতারের আগে ও পরে গুলীতে ১৮ জন, গ্রেফতারের পর আত্মহত্যার শিকার ১ জন এবং অসুস্থ অবস্থায় ৪ জন মারা গিয়েছেন। একই বছর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়দানকারীদের হাতে মোট ৬০ জন অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের পুত্র সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আল আযমীকে ও জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর পুত্র ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমানকে একই বছরের ৯ আগস্ট পুলিশের পরিচয় দিয়ে তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অদ্যাবধি তাদের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে দেশে কী সাংঘাতিক খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। সরকার গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও জনগণের ভোটাধিকার নির্বাসনে পাঠিয়েছে।
অধ্যাপক মুজিব বলেন, গত ২৮ ডিসেম্বর দেশের পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদের বিভিন্ন পদে ১২৭টি এলাকায় সাধারণ, স্থগিত নির্বাচন ও উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও নির্বাচনের সচ্ছতার ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকগণের সাথে যে সংলাপ করেছে তা সাজানো প্রহসনের নাটকে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণে। বেড়েছে চাল, আটা, চিনি, লবণ, পিঁয়াজ, মাছ, গোশতসহ তরিতরকারির দাম। দ্রব্যমূল্যের তীব্র কষাঘাতে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, হতদরিদ্র ও সাধারণ জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। ৩৫ টাকা মূল্যের মোটা চাল বর্তমানে বিক্রয় হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। চালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে গত এক বছরে দরিদ্র হয়েছে অগণিত লোক। চালের দাম বৃদ্ধি এখনো অব্যাহত আছে। অর্থনীতির সকল সূচকই নি¤œগামী। বিনিয়োগ কমেছে, বৈদেশিক আয় কমেছে। সরকার একের পর এক দেশের বেসরকারি সচ্ছল ব্যাংকগুলোকে দখল করে নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও নৈরাজ্যজনক অবস্থা বিরাজ করছে।
তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সালের বেশীর ভাগ সময় জুড়েই ছিল বিচার বিভাগ নিয়ে সরকারের নানা ধরনের নাটকীয়তায় পূর্ণ। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী রায় না দেয়ায় প্রধান বিচারপতিকে সরকার প্রথমে ছুটিতে পাঠিয়েছে ও তারপরে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এখন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দান না করায় বিচার বিভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিচার বিভাগের উপর সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া এখনো চলছে।

তিনি বলেন, সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ছাত্র/ছাত্রীদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার এবং বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকার পরীক্ষাকে একটি প্রহসনে পরিণত করেছে। পরীক্ষাকে প্রহসনে পরিণত করে যথাযথ শিক্ষা ছাড়াই ছাত্র/ছাত্রীদের পাশ করিয়ে দিয়ে সরকার জাতিকে মুর্খ বানানোর ব্যবস্থা করেছে। দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত পিইসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে ৩৬০টি স্কুল থেকে কেউই পাশ করতে পারেনি। জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, ৫৯টি স্কুল থেকে কেউই পাস করতে পারেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকগণ বেতন বৈষম্য অবসানের দাবিতে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরণ অনশন শুরু করেছিল। শিক্ষামন্ত্রীর দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাসে তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে। এদিকে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীগণ ৩১ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেছে। এ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, দেশে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, গত ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের ঘাড়ে গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার ন্যায় চাপিয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। মিয়ানমার সরকার ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানকে বিতারিত করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক দুর্বলতা ও ব্যর্থতার চিত্র ফুঠে উঠেছে। এ সমস্যার আশু কোন সমাধানের সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

২০১৮ সালে প্রত্যাশার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে অধ্যাপক মুজিব বলেন, নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই ২০১৮ সালে জাতির প্রত্যাশা। জাতির প্রত্যাশাকে পাশ কাটিয়ে সরকার যদি আগের মত ভোটার বিহীন প্রহসনের সাজানো নির্বাচনের ষড়যন্ত্র শুরু করে তাহলে তার পরিণতি কারো জন্যই শুভ হবে না। দেশের সামগ্রিক অবস্থায় জনগণের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। দেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে তা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ হলো নির্দলীয়, নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সারা দুনিয়ায় আলাপ-আলোচনাই সমস্যা সমধানের পথ হিসেবে স্বীকৃত। তাই বিরোধীদলগুলোর সাথে সরকারের সংলাপ শুরু করার প্রয়োজনীয়তা জাতি উপলব্ধি করছে। কিন্তু সরকার সে পথে না গিয়ে দেশকে সংঘাত-সংঘর্ষের পথে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে নির্বাচন যাতে নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে সে জন্য কার্যকর পদক্ষেপ সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। আমরা আশা করি সরকার দেশকে সংঘাত-সংঘর্ষের পথে ঠেলে না দিয়ে বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করবে এবং দেশকে নির্বাচনমুখী করবে।
তিনি আরো বলেন, সরকার যদি সোজা পথে না হাঁটে তাহলে বিরোধী দলগুলোর পক্ষে আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প থাকবে না। নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয়ার ব্যাপারে আগামী ২০১৮ সালে কার্যকর ভূমিকা পালন করার জন্য তিনি দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

মির্জা ফখরুল: বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় বিদায় বছরেও (২০১৭) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আচরণ ছিল হিংস্বাত্বক ও ধ্বংসাত্বক। শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা দেশের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারবিভাগকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শেষ করে দিয়েছে। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া এখন নিয়মে পরীণত হয়েছে। ঘুষ, দুর্ণীতি এখন অপেন সিক্রেট। সরকারের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে ঘুষ নিতে বলছেন। তিনি বলেন, এই অবৈধ সরকার আবারো বাকশাল কায়েমের স্বপ্নে বিভোর। তারা আরেকটি একতরফা নির্বাচন আযোজনের ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু তাদের সেই আশা কোনদিন পূরণ হবে না। দৈনিক সংগ্রামের পক্ষ থেকে বিদায়ী বছর সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি এসব কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে অবৈধ মইন-ফখরুদ্দিনদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের উপর স্টিমরোলার চালাতে থাকে। তাদের লক্ষ্য একটাই, বিরোধী মতকে দমন করে ক্ষমতাকে দীর্ঘ করা। তারা বিএনপি, দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারই অংশ হিসেবে বেগম জিয়াকে তার দীর্ঘদিনের ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দিয়েছে। বেগম জিয়া, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করতে থাকে। অথচ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন নেতাদের বিরুদ্ধেও অনেকগুলো মামলা ছিল। কিন্তু সরকার সেগুলো প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তিনি বলেন, এই সরকার বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে যেনতেনভাবে একটি রায় দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যার মাধ্যমে তাকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য করা যায়। কিন্তু সেটি সম্ভব হবেনা। তিনি বলেন, গত একবছরে বেগম জিয়াকে প্রায় প্রতিমাসে এবং কখনো কখনো সপ্তাহে একাধিক দিন কারাগারে হাজিরা দিতে হয়েছে।

সরকারকে মামলাবাজ মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, এই সরকার গত ৯ বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা করেছে। অনেক নেতাকর্মীকে গুম করেছে। গেল বছরেও বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গুম করেছে। তিনি বলেন, আমাদের দলের অনেক সিনিয়র নেতা এখনো কারাগারে। সহযোগি সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই সরকার তাদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। অথচ তারাই এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নাই হয়ে যাবে। তারা এটি নিশ্চিৎ জেনেই সংবিধান পরিবর্তন করেছে। কিন্তু তাদের একতরফা নির্বাচনের ইচ্ছে কখনোই পূরণ হবে না। তিনি বলেন, গত বছরও আমরা জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় রাজপথে ছিলাম, লড়াই করেছি, নতুন বছরেও লড়াই করব এবং ২০১৮ সালে আমরা অবশ্যই জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করব। একাদশ নির্বাচনে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই অংশ নেবে। দেশনেত্রী নির্বাচনে যাবেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থাকবে না।
মির্জা ফখরুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা আশাবাদী হয়ে উঠছি অনেক কারণে। আমরা বলতে চাই, ২০১৮ সাল দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাল, ২০১৮ সাল বিএনপির সাল, ২০১৮ সাল তারেক রহমানের সাল, ২০১৮ সাল এদেশের গণমানুষের সাল; যারা লড়াই করে, যুদ্ধ করে এদেশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে এনেছে তাদের সাল। মির্জা ফখরুল বলেন, কথা খুব স্পষ্ট- নির্বাচন তো দিতেই হবে। সেই নির্বাচন হতে হবে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, সেই নির্বাচন হতে হবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় সকল দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। অবশ্যই তা সুষ্ঠু-অবাধ হতে হবে, সেই নির্বাচন হবে; ইনশাল্লাহ সেই নির্বাচনে অবশ্যই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন।

দেশ বর্তমানে ঘুষ-দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আগের বছরগুলোর থেকে বিদায়ী বছরে আরো বেশী করে সরকার শিক্ষাব্যবস্থা, হাসপাতাল, ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঝাঁঝরা করে ফেলেছে। ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ বিভিন্ন লীগকে তারা চাঁদা দিয়ে আর পেরে উঠতে পারছে না। এ জন্য তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দিচ্ছে। সরকারি অফিসে চাকরি দেয়ার নামে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেয়া হচ্ছে; এটাকেও আওয়ামী লীগ উন্নয়ন বলে প্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ঘুষ-দুর্নীতি এখন অপেন সিক্রেট। শিক্ষামন্ত্রী প্রকাশে ঘুষ নেয়ার পক্ষে কথা বলেছেন।

বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, সরকার গেল বছরে প্রধান বিচারপতিকে বন্দুকের নলের মুখে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। তারা দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই হচ্ছে আওয়ামী লীগের অবদান। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ ধ্বংসের মুখে। টাকা দিলেই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন মেলে। প্রধানমন্ত্রীর সততার প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কনস্টেবলের চাকরি থেকে শুরু করে সবখানে টাকা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। এমনকী হাসপাতালকেও বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচির জন্য চাঁদা দিতে হয়। সব জায়গায় দুর্নীতি ছড়িয়ে গেছে, আর প্রধানমন্ত্রী নাকি সৎ নেতা!
মির্জা ফখরুল বলেন, পত্রিকা বলছে, উন্নয়নে নামে যে একটা ধূম্রজ্বাল সৃষ্টি করা হয়েছে সেই উন্নয়ন আসলে একটা তাসের ঘর। শিক্ষিত যুবকদের ৪৭% কোনো চাকরি পায় না। প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। টাকা দেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি পাবেন, টাকা দেবেন মেডিকেল কলেজের অনুমতি পাবেন, টাকা দেবেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনির্ভাসিটির অনুমতি পাবেন। গুম ও টাকা- এর উপরেই এখন সবকিছু চলছে। সর্বত্র দুর্নীতি চলছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা একেবারে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব খালি কলসের মধ্যে পানি নাই, শব্দ করে বেশি।

ফখরুল বলেন, এই সরকার সম্পর্কে আর কি বলব? কোন খারাপ কাজটা তারা করে নাই? আমরা গণতন্ত্র বলতে যা বুঝি গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল ফর দ্যা পিপল। আর এখন কি হচ্ছে গভর্নমেন্ট ফর অন পার্টি, গভর্নমেন্ট ফর অন পারসন। আওয়ামী লীগ শুধু মাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের সমস্ত অর্জনগুলোকে ধ্বংস করে দিয়ে আজকে একটা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেছে। এটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের লজ্জা সরম বলতে কিছু নাই। বেহায়ার মতো বলছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। সংবিধান কোনো সংবিধান? এ সংবিধান কোনটা? এমন একট সংবিধান আপনারা সংশোধন করেছেন, যে পার্লামেন্টে করেছেন সেটা জনগণের নয়। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের সব আদর্শকে ধ্বংস করছে। আসল কথা হলো, আওয়ামী লীগের আদর্শ বলতে কিছুই নাই।
মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ: বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীরে শরীয়ত মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হুজুর বলেছেন, বিদায়ী ২০১৭ সালে সবদিক দিয়ে অবনতি হয়েছে। মসজিদের ইমামসহ জনগনের জানমালের নিরাপত্তা নেই। সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে কোন কিছু করা হবে না। কিন্তু বিদায়ী বছরে নাস্তিকরা ইসলামের অবমাননা করেছে সবচেয়ে বেশি।
তিনি দ্রব্যমূল্য সর্ম্পকে বলেন, বিদায়ী বছর ছিল দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির বছর। এ বছর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পেয়াঁজ ও চালসহ নিত্যপণ্যের দামে অসহনীয় অবস্থানে রয়েছে জনগণ। আইন শৃংখলার দিক দিয়েও দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ অবস্থানে নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ইসলামী হুকুমত ও খোদাভীরু নেতৃত্ব।

নতুন বছরের প্রত্যাশা সর্ম্পকে তিনি বলেন, বিদায়ী বছরের সকল অন্যায় ও খারাপি মুছে দিয়ে নতুন বছরে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েম হবে। তখন দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, দ্রব্যমূল্য কমে আসবে এবং মানুষ শান্তিতে বসবাস করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক: খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বলেছেন, বিদায়ী বছর ছিল দুর্দশার বছর। গুম, খুন, অপহরণ ও বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে মানুষকে। বিদায়ী বছরে রাস্তা ঘাটের উন্নতির পাশাপাশি হত্যা, ধর্ষণ ও চাঁদবাজির উন্নতিও হয়েছে। বর্তমান সরকার সত্যিকারভাবে নির্বাচিত সরকার নয়, তাই তারা জনগনের দুঃখ দুর্দশা লাগবে কোন কাজ করেনি।

নতুন বছর ভালো হবে বলে প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেছেন, নতুন বছর হবে গণতন্ত্রের বছর। আশা করি এ বছরে গণতন্ত্র ফিরে আসবে। জনগনের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে জনগনের বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে সাহস পাবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পীর সাহেব চরমোনাই: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বলেছেন, বিদায়ী বছরে দেশে যেভাবে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, গুম-খুন, ব্যাংক লুটপাটের মতো ঘটনা ঘটেছে, ২০১৮ সালে এমন সব দেশ বিরোধী কর্মকান্ড পরিহার করে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দু:শাসনমুক্ত কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হবে নতুন বছরে দেশবাসীর অঙ্গীকার।

পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, দেশের স্থায়ী শান্তি ও মানবতার সার্বিক মুক্তির লক্ষে মানুষ ঈমান ও ইসলাম নিয়ে বাঁচতে চায়। নিরাপদে বসবাস, ব্যবসা বাণিজ্য, চলা ফেরা করতে চায়। হয়রানী থেকে মুক্ত থাকতে চায়। সন্তানরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চায়। ন্যায় বিচার ও সুশাসন চায়। অবাধ-সুষ্টু নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা চায়। চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও দখলদারিত্ব মুক্ত বাংলাদেশ চায়।
তিনি বলেন, সর্বোপরি ঈমান, ইসলাম ও মানবাধিকার নিয়ে বাঁচার যে চাহিদা তা পূরণে ক্ষমতাসীনরা কার্যকরী পদক্ষেপ নিবে বলে নতুন বছরে দেশবাসী প্রত্যাশা করে। সরকার যদি নতুন বছরে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে আগের মতো দুর্নীতি-সন্ত্রাস, দুঃশাসন, খুন-গুম, ব্যাংক লুটপাট করে তবে দেশবাসী আগামী নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে উচিত শিক্ষা দিবে।

http://www.dailysangram.com/post/313430