১ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:২৪

স্বাস্থ্যখাতে চিকুনগুনিয়া ঝড় ওষুধের দামে অস্বস্তি

বিদায়ী বছরে স্বাস্থ্য খাতে আলোচিত বিষয় ছিল চিকুনগুনিয়া জ্বর। চিকুনগুনিয়ায় ঝড়ে কাঁপছিল গোটা দেশ। জীবন রক্ষাকারী কিছু ওষুধের দাম বৃদ্ধি পায় এ বছর। এতে জনগণ ছিলেন অস্বস্তিতে। নার্সদের চাকরি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসও আলোচনায় আসে বিদায়ী সালে। পরে পাবলিক সার্ভিস কমিশন এই পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়।
ভুল চিকিৎসায় ঢাবি’র ছাত্রীর মৃত্যুর অভিযোগ ব্যাপক আলোচনায় আসে। অন্যদিকে সরকার হার্টের রিংয়ের দাম, হার্টের ভাল্ব ও পেসমেকারের খুচরামূল্য নির্ধারণ এবং চোখের লেন্সের দাম ঠিক করে দেয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জনগণ। জোড়া লাগানো দু’শিশু হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেও মুক্তামণি কষ্ট নিয়ে গ্রামে গেছে। আর স্বাস্থ্যখাতের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে মানুষ আলোচনায় রেখেছেন ২০১৭ সালকে।

চিকুনগুনিয়া ঝড়: বিদায়ী বছরে স্বাস্থ্যখাতে আলোচিত রোগ ছিল চিকুনগুনিয়া। চিকুনগুনিয়া ঝড়ে কাঁপছিল
গোটা দেশ। এক পর্যায়ে সবার মুখে মুখে ছিল চিকুনগুনিয়া জ্বরের কথা। ঘরে ঘরে ছিল এই রোগের আতঙ্ক। ডাক্তার, নার্সরাও বাদ যায়নি। একজনের এই জ্বর হলেই অন্যরাও ভয়ে থাকতেন। কখন না আবার তারও এই জ্বরে পেয়ে বসে। এই জ্বরের ভয়ে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামেও ‘পালিয়ে’ গিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে প্রথম দেখা পাওয়া এই জ্বর রাজধানীসহ সারা দেশেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে প্রথম এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও এবছর আলোচনায় আসে বেশি। চিকুনগুনিয়া রোগ বিষয়ে আগাম সতর্কতা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিল রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। এডিস ঈজিপ্টাই অথবা এডিস অ্যালবুপিক্টাস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায় এই রোগ।
ওষুধের দামে অস্বস্তি: বিদায়ী বছরে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম কম ছিল না। বরং কিছু ওষুধের দাম শুধু বাড়তির দিকে ছিল। ওষুধ কিনতে গেলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। দাম বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা ওষুধ প্রশাসনের নেই। অন্য দিকে ওষুধের দাম বেড়েছে এমন অভিযোগ ওষুধ কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি স্বীকার করে না। তবে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন বিষয়ে ব্যক্তিরা বলছেন, সংশোধিত ওষুধ নীতিই ওষুধের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে পরিবর্তন না হলে এত ঘন ঘন এবং অযৌক্তিকভাবে ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়াতে পারতো না। ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় সব কোম্পানির মধ্যে একটি মতৈক্য আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি কোম্পানি কোনো ওষুধের দাম বাড়ালে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অন্যান্য কোম্পানি দাম বাড়িয়ে নেয়। ওষুধের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ওষুধ প্রশাসনের কিছু করার নেই। নিয়ম অনুযায়ী ওষুধ কোম্পানি দাম প্রস্তাব করে তাদের কাগজপত্র দেখে শুধু অনুমোদন করে দেয়া হয়। তবে ১১৭টি ‘অ্যাসেনশিয়াল’ ওষুধের দাম আমরা নির্ধারণ করে দেই, এসবের দাম বাড়েনি।

হার্টের রিংয়ের দাম নির্ধারণ: ওষুধ প্রশাসন হতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ইস্যুকৃত কার্ডিয়াক স্ট্যান্ট (হার্টে রিং)-এর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। তা হাসপাতালগুলোতে পাঠানো হয়। বিদায় বছরের এপ্রিল মাসে সরকার নিয়ম অনুযায়ী ২৬টি ব্র্যান্ডের খুচরা মূল্য (বিধি অনুযায়ী মার্ক আপ) নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি করতে হবে হার্টের রিং। এই মূল্য তালিকা জনসাধারণের চোখে পড়ে হাসপাতালের এমন জায়গায় টানানোর নির্দেশ দেয়া হয়। রিংয়ের গায়ে মূল্য, উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ লেখা থাকতে হবে। এরফলে মনগড়া ব্যবসা বন্ধ হওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে প্রতি একক সর্বোচ্চ মূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকা ও সর্বনিম্ন ২০ হাজার ৪০৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে হার্টের রিং পরানো নিয়ে বাণিজ্য হয়ে আসছিল দেশে। মেডিকেটেড রিং (ওষুধ দিয়ে) সবচাইতে দামি। অন্যদিকে নন মেডিকেটেড (ওষুধ ছাড়া) রিংয়ের দাম তুলনামূলক কম। সরকারি হাসপাতালে রিং ভেদে ৪০ থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে মেডিকেটেড রিং (ওষুধ দিয়ে) বিক্রি হতো ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায়। আর নন মেডিকেটেড (ওষুধ ছাড়া) রিং বিক্রি হতো ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। যেটি সরকারি হাসপাতালে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। রোগীদের কাছে নিম্নমানের রিং দিয়ে উন্নতমানের রিংয়ের দাম নেয়ার অভিযোগও কম নয়।

হার্টের ভাল্ব ও পেসমেকারের খুচরা মূল্য নির্ধারণ: দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের হৃদরোগীদের জন্য কার্ডিয়াক ডিভাইসের (হার্টের ভাল্ব ও পেসমেকার) এমআরপি মূল্য নির্ধারণ করে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। মূল্য নির্ধারণে হার্টের ভাল্বের ক্ষেত্রে মডেল ও কোম্পানি ভেদে ৪ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম কমানো হয়। পেসমেকারের ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকা থেকে ৪ লাখ ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম কমানো হয়েছে। জানা গেছে, হার্টের ভাল্ব ও পেসমেকারের মূল্য নির্ধারিত না থাকায় রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করা হতো। বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নজরে এলে গত ২৮শে নভেম্বর কার্ডিওলজিস্ট, কার্ডিয়াক সার্জন এবং মেডিকেল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সভায় সকলের মতামতের ভিত্তিতে পেসমেকার ও ভাল্বের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
চোখের লেন্সের দাম নির্ধারণ: বিদায়ী বছরে সরকার চোখের কৃত্রিম লেন্সের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১৫টি ব্র্যান্ডের লেন্সের দাম নির্ধারণ করে দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। মানভেদে ১২শ’ টাকা থেকে শুরু করে ৫৮ হাজার টাকায় কৃত্রিম স্বচ্ছ লেন্স কিনতে পারবেন রোগীরা। কেউ এই দামের বাইরে লেন্স বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন। এর আগে অনেকে অপারেশনসহ ৪০ হাজার, ৫০ হাজার ও ৬০ হাজার টাকা নিতেন চোখের কৃত্রিম লেন্সে।

মুক্তামণি: ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) বার্ন ইউনিটে দীর্ঘ ছয় মাস চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছে রক্তনালীর টিউমারে আক্রান্ত বার বছর বয়সী শিশু মুক্তামণি। মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ওর (মুক্তামণি) হাত ফুলে যাচ্ছে। ভালো তেমন হচ্ছে না। হাতে কোনো অনুভূতি পাচ্ছে না। ডাক্তাররা দীর্ঘ ছয় মাস চেষ্টা করেছেন। হাতের ওজন ৩ থেকে ৪ কেজি ছিল। যা আগের মতোই। তেমন উন্নতি হয়নি। চিকিৎসকরা বলেছেন, দুই বছর সময় লাগবে। হাতে আগে গন্ধ হতো এবং পোকা হতো। তা এখন হচ্ছে না। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, মুক্তামণি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। কয়েকদিনের জন্য রিলিজ দেয়া হয়েছে। সে আবারো আসবে। মুক্তামণির বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ কামার বায়েশা গ্রামে। বিদায়ী বছরের ১২ই জুলাই ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হয় সে।
জোড়া লাগানো দু’শিশুর বাড়ি ফেরা: বাড়ি ফিরছে তোফা ও তহুরা। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের গ্রামের শিশু দুটি বিরল ‘পাইগোপেগাস’ রোগে ভুগছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল শিশু সার্জারি বিভাগে তোফা ও তহুরাকে পৃথক করে। পাইগোপেগাস শিশু পৃথক করার ঘটনা বাংলাদেশে এটিই প্রথম বলে জানান চিকিৎসকরা। প্রায় ৯ ঘণ্টার অপারেশন শেষে তাদের আলাদা করা হয়।

ভুল চিকিৎসায় ঢাবি’র ছাত্রীর মৃত্যুর অভিযোগ: ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ক্যানসারের চিকিৎসা দেয়ায় তার মৃত্যুর অভিযোগ ওঠেছিল সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হাসপাতাল ভাঙচুর করেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সসহ ৯ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর বিষয়টি উভয়পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলে।
এদিকে নার্সদের চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পরে পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়। বিদায়ী বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতে চিকিৎসকদের রাউন্ড দেয়ার ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি অনেকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।

 

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=98563