১ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:০৯

দো-আঁশলা গণতন্ত্রের বছর ২০১৭

বিদায় ২০১৭। কালের প্রবাহে সমগ্র বিশ্ববাসীর জীবন থেকে একটি বছর চলে গেল। বছরের শেষে ২০১৭ সালটি বাংলাদেশের মানুষের জীবনে কেমন কেটেছে তার হিসাব-নিকাশ চলছে গণমাধ্যমে এবং অভিজ্ঞজনদের মূল্যায়নে। পত্র-পত্রিকায় যা-ই লেখা হোক, সম্প্রচার মাধ্যমে যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, এ ব্যাপারে ১৬ কোটি মানুষের মনের খবর কারও পক্ষেই সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সূচনার পর থেকে দেখা যাচ্ছে মানব জীবনকে স্পর্শ করে এমন সব বিষয় নিয়ে থিংকট্যাংকগুলো নানা ধরনের জরিপ চালাচ্ছে এবং এসব জরপের নিরিখে নানারকম সূচক প্রকাশ করছে। বিষয়গুলো এমন যে, এগুলো সম্পর্কে সংখ্যাবাচক মূল্যায়নের চেয়ে গুণবাচক মূল্যায়নই শ্রেয়। কারণ যেসব মূল্যায়ন করা হয়, সেগুলোর ভিত্তি হল হিউম্যান পারসেপশন। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কিছু বিষয়ে মানুষ দ্রুত ভাবতে পারে, আবার এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো সম্পর্কে দ্রুত মতামত দেয়ার অবকাশ নেই। মতামত বা উত্তর দিতে হয় ভেবেচিন্তে। অনেক সময় চিন্তা-ভাবনা করে উত্তর দিলেও সঠিক অবস্থার প্রতিফলন হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় উত্তরদাতাদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ কী? বেশির ভাগ উত্তরদাতা বলেছিল, বড় কারণটি হল সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, মৃত্যু হারের দিক থেকে সড়ক দুর্ঘটনার স্থান অনেক নিচে। এরকম তাৎক্ষণিক জবাবের কারণ হল- মিডিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার খবর যেভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয়, ঠিক গুরুত্ব দিয়ে অন্য কারণজনিত মৃত্যুর খবরগুলো প্রচার করা হয় না। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের হাল কী ছিল সে সম্পর্কে বলতে গেলে এরকম বিভ্রাট তৈরি হতে পারে।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরিদ জাকারিয়া বলেছিলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে Illiberal democracy বা অনুদার গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটছে। গণতন্ত্র একেবারেই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে এমনটি বলতে চান না ফরিদ জাকারিয়া। অনেক উন্নয়নশীল দেশে যে ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা হয় সেটি অনুদার এবং অসহিষ্ণুতার বেড়াজালে আবদ্ধ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমি এতদিন ফরিদ জাকারিয়ার সঙ্গে সহমত পোষণ করে অনুদার গণতন্ত্রের তকমাটি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ২০১৭ গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশে কেমন বছর ছিল তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আরেকটি নতুন পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত হলাম। The Economist Intelligence Unit 2016 সালের শেষে গণতন্ত্রের একটি সূচক তৈরি করেছিল। যখন বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অধোগতি চলছে তখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সূচক স্থির হয়ে আছে। ২০১৬ সালের এই পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করেই আমাদের জন্য ২০১৭ সাল কেটেছে। ঊওট-এর মতে, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হলেও এতে রয়েছে একটি হাইব্রিড রেজিম। দেশটি ২০০৮ সাল থেকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। হাইব্রিড রেজিমের ১৬৭টি জাতির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৪তম। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৬তম। ২০১৫ সালে বৈশ্বিক গড় স্কোর (০-১০ স্কেলে) ৫.৫৫ থেকে ২০১৬-তে ৫.৫২-তে নেমে আসে। এই সূচক থেকে বোঝা যায়, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের হালচাল কেমন। এই সূচকটির ভিত্তি হল রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ২০১৬ সালে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুবাচনিকতায় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৭.৪২; নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ৬.৭৬; সরকারের কার্যক্রমে ৫.০৭; রাজনৈতিক অংশগ্রহণে ৫.০০ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ৪.৩৮। এর ফলে ২০১৬ সালে সার্বিক স্কোর দাঁড়িয়েছিল ৫.৭৩। প্রত্যেকটি দেশকে গণতন্ত্রের দিক থেকে এবং এর সরকারের ধরন থেকে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হল- যথাক্রমে পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিন্ম ধাপ থেকে মাত্র এক ধাপ ওপরে। Economist Intelligence Unit-এর মূল্যায়নে বাংলাদেশে চলছে শংকর জাতীয় বা দো-আঁশলা শাসনব্যবস্থা। সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুবই নিপীড়ক ও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহনশীলতার মনোভাব দেখায়। কড়ি ও কোমলের এই মিশ্রণ অনেকটাই কৌশলপ্রসূত। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে সরকার যখন সহনশীল মনোভাব দেখায় তখন এটাকে উদারতা বলে অনেকেই হয়তো চিহ্নিত করতে রাজি হবেন না। নির্জলা কঠোর শাসনের ব্যত্যয় ঘটানোর পেছনে কাজ করে শাসনব্যবস্থাটিকে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রলম্বিত করার অনৈতিক মনোভাব।

সামগ্রিকভাবে ২০১৭ সাল অসহনশীল ও অশোভন মন্তব্যের দিক থেকে উত্তাপ ছড়ালেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাঠ ছিল বেশ নিরুত্তাপ। বছরের শুরুতে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। দলীয় মার্কাভিত্তিক এই নির্বাচনে সরকারবিরোধী বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করেছে। এই নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে হাজির করে সরকার জানাতে চেয়েছে তাদের শাসনকালেও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী জয় লাভ করে। বছরের শেষে হল রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল নৌকা মার্কার প্রার্থী এবং তৃতীয় অবস্থানে ছিল বিএনপি। বিশ্লেষকদের মতে, রংপুরের এই নির্বাচনটি খুবই ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ রংপুর বিভাগটি অনেকটা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ঘাঁটি। সুতরাং সেখানে লাঙ্গলের বিজয়কে স্বাভাবিক বলেই অনেকে মনে করেন। কিন্তু যেহেতু এরশাদের দল মহাজোটের অংশীদার এবং সরকারে এই দলের দু’জন মন্ত্রী আছেন, সেহেতু এই দলটিকে অধিকাংশ বিশ্লেষকই সরকারবিরোধী দল হিসেবে গ্রহণ করতে চান না। রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারের হার হল না জিত হল- সেটাও বিভ্রান্তির ধোঁয়াশায় অস্পষ্ট হয়ে যায়। তবে নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ হওয়ায় কেউ যদি ভাবেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছুটা হলেও উত্তরণ হচ্ছে তাহলে তাদের দোষ দেয়া যাবে না। রংপুরের এই নির্বাচনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এর পরিসংখ্যান। ভোটের হিসাবে দেখা যায়, জাতীয় পার্টির ভোট বেড়েছে গত নির্বাচনের তুলনায় ১০৫ শতাংশ, বিএনপির ভোট বেড়েছে ৬৫ শতাংশ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভোট প্রাপ্তির হার কমেছে। তবে আগের বারের নির্বাচনের সঙ্গে এবারের নির্বাচনের তুলনা অনেকটাই বিভ্রান্তিকর। কারণ রংপুর সিটি কর্পোরেশনের চৌহদ্দি আগের বারের তুলনায় বড় ছিল। প্রার্থী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি বলে অনেকে মনে করেন। সব দিক বিবেচনা করলে বলা যায়, এই নির্বাচনটি পরিসংখ্যানশাস্ত্রের বিচারে সাধারণ ধারার বাইরে অবস্থান করছে।

রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনেকটা সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল হলেও নির্বাচন কমিশন এই গৌরবের ধারা ধরে রাখতে পারেনি। কারণ বছরের শেষে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনগুলো বহুলাংশে নির্বাচনী কারচুপি, ভোট জালিয়াতি এবং অবাঞ্ছিত কার্যকলাপের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে পোলিং অফিসারদের যোগসাজশ এই নির্বাচনগুলোকে কলুষিত করেছে। নির্বাচন কমিশন এ ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি প্রতিরোধ করতে পারেনি। দু-একটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠান রোধ করার সাহস দেখাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এর ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আস্থা আরও দুর্বল হয়েছে।

এ বছর নতুন নির্বাচন কমিশনটি যে প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে গেছে। আশা করা হয়েছিল, ২০১৮ সালের শেষে অথবা ২০১৯ সালের শুরুতে জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন হবে সে ব্যাপারে হতাশা ও অনাস্থার মেঘ কেটে যাবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য যে, আজ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত আইনটি প্রণীত হয়নি। সার্চ কমিটি দিয়ে কমিশন গঠনের প্রণালীও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। গণতন্ত্রের সাফল্য বহুলাংশেই নির্ভর করে সুঠাম সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। কিন্তু আমাদের দেশের যেসব রাজনৈতিক দল অতীতে ক্ষমতায় ছিল এবং বর্তমানে ক্ষমতায় আছে তারা কেউই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবল-সাহসী ও নিরপেক্ষ করে গড়ে তোলার সৎ সাহস দেখাতে পারেনি। বরং প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে দিনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য এবং দেশ পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অপরিহার্যতার নৈতিক অঙ্গীকারটি ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে রাখার সুবিধাবাদের নিকট পরাস্ত হচ্ছে উত্তরোত্তর। দেশ-জাতি ও জনগণের জন্য এটি কখনই মঙ্গলজনক হতে পারে না।
২০১৭ সালজুড়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত ছিল। সরকারপক্ষের অনড় মনোভাব হল- সংবিধানের ছকের মধ্যেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের দাবি হল একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এই বিপরীতমুখী যাত্রায় সাধারণ নাগরিকরা কোনো সমাধানের চিহ্ন দেখতে পায় না। দেশ যে একটি চরম অনিশ্চয়তার মুখে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এই দুর্ভাবনা জনগণকে হতাশ করে তুলছে। এমনকি অনুদার বলি আর হাইব্রিড বলি, তার অবসানও আশা করা যাচ্ছে না। বর্তমান সংবিধানিক ব্যবস্থা অনুসারে সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু পথিবীতে যেসব দেশে ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপ পার্লামেন্টারি ডোমোক্রেসি আছে, সেসব দেশে কোথাও সংসদ বহাল রেখে সংসদীয় নির্বাচনের নিয়ম বা রীতি নেই। কারণ, এর ফলে নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ডের চরম বিচ্যুতি ঘটে। কী কারণে বর্তমান শাসক মহল এ ব্যাপারে অনমনীয় অবস্থান নিয়েছে তা বোঝা দুষ্কর। এই অদ্ভুত বিধান গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জনগণকে আশাবাদী হতে দেয়া না।

স্বাধীন বিচারব্যবস্থা সুষ্ঠু গণতন্ত্রের অন্যতম অপরিহার্য শর্ত। দুঃখজনক হলেও ২০১৭ সালে আমরা শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে চরম অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি হতে দেখেছি। এই অস্বস্তি চরম আকার ধারণ করল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায়ের পর। প্রথম দিকে এই রায়ে কতিপয় পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে শাসক মহলকে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখলাম। তারপর এই উষ্মা সম্প্রসারিত হল খোদ প্রধান বিচারপতির ওপর। অভিযোগ উঠল তিনি দুর্নীতি করেছেন। কিন্তু কথা হল, একজন মানুষতো হঠাৎ করে একদিনে দুর্নীতিবাজ হয়ে যায় না। যারা দায়িত্বশীল পদে থাকেন তারা যদি দুর্নীতিবাজ হন, তাহলে দুর্নীতির সে অভ্যাস বেশ কিছুটা সময় নিয়ে গড়ে ওঠে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে বিচারপতি এসকে সিনহা ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের অব্যবহিত পূর্বে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন, নাকি তারও অনেক পূর্ব থেকেই এই অবাঞ্ছিত কর্মে তিনি লিপ্ত। যে ধরনের দুর্নীতির কাহিনী আমরা শুনতে পেয়েছি এবং কিছু কিছু মিডিয়ায় সেগুলো এসেছেও, সেগুলো এমন মারাত্মক দুর্নীতি যে তা হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি। যখন তাকে অপর বিচারপতিকে ডিঙিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তখন এ ব্যাপারে নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষ কেন খোঁজ-খবর নেননি। অবশেষে বিচারপতি সিনহা দেশ ছাড়লেন এবং বিদেশে থেকেই পদত্যাগপত্র দিলেন। এসব নিয়ে গুজবের ডাল-পালা বিস্তার লাভ করেছে। সবকিছু অদৃশ্যমানতার অবগুণ্ঠনে লুকিয়ে আছে। ঘটনাবলীর সত্যতা ও অসত্যতা যাই হোক না কেন, পুরো ব্যাপারটি রাষ্ট্রের দুটি স্তম্ভের মধ্যে তীব্র অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। গণতান্ত্রিক সুস্থতার জন্য এটি ছিল একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। আগামী দিনগুলোতে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের হাইব্রিড গণতন্ত্র আরও নাজুক হয়ে পড়বে বৈকি।

২০১৭ সালে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অব্যাহত ছিল। সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষ যেভাবে রাজনৈতিক বিতর্কের নামে কটুকাটব্যের আশ্রয় নিয়েছে, সেটি ছিল খুবই দুঃখজনক। বাকযুদ্ধ এমন রূপ নিয়েছিল যে, মনে হচ্ছিল একপক্ষ অন্য পক্ষের অবস্থান মুছে ফেলবে। নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসার উক্তিটিও শোভনীয় ছিল না। দেশবাসী সমালোচনার হুল ফোটানোতে আপত্তি না করলেও সমালোচনা গরলে পরিণত হোক এমনটি আশা করে না। বাস্তবতা হল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উভয় পক্ষই শক্তিমান। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে যখন দেখা যায়, বিবদমান পক্ষদ্বয় প্রায় সমশক্তির অধিকারী তখন সংঘাতের পরিবর্তে সমঝোতার পথই বেছে নেয়া হয়। আমাদের জাতীয় জীবনে এই দৃষ্টান্ত কেন ক্রমেই সুদূর পরাহত মনে হচ্ছে তার কূল-কিনারা করা কঠিন। গণতন্ত্রে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার বিকল্প নেই। কিন্তু সমঝোতার পরিবর্তে সংঘাতের পথ বেছে নেয়া হলে গত ৪৬ বছরে আমাদের যা কিছু অর্জন হয়েছে তা হারিয়ে যেতে পারে। এই উপলব্ধি সবপক্ষের মধ্যেই সঞ্চারিত হওয়া উচিত। অন্যথায় গণতন্ত্র নির্বাসনে যাবে, দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২০১৭ সালে আরেক ধরনের অমঙ্গল গণতন্ত্রের ওপর করাল ছায়া বিস্তার অব্যাহত রেখেছে। অতীত বছরগুলোর মতো এ বছরেও গুম ও অপহরণের অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। যারা গুম ও অপহরণের শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সম্মানজনক পেশার অনেক মানুষ। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এসেছেন। কিন্তু ফিরে আসার পর তারা মুখ খোলেননি। শুধু টাকার জন্য অথবা ব্যবসায়িক শত্রুতার জন্য তারা অপহৃত হয়েছিলেন, সাধারণের মনে এসব কাহিনী শিখিয়ে দেয়া বুলি বলে চিহ্নিত হয়েছে। অনেকেরই ধারণা আসল কথাটি তারা ভয়ে চেপে যাচ্ছেন। আজ পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো বিশ্বাসযোগ্যভাবে উদ্ঘাটিত হয়নি। অথচ জননিরাপত্তার স্বার্থে এসব রহস্য উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। এগুলোর বিহিত করা রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব। অন্যথায় রাষ্ট্রের বৈধতা ক্ষুণ্ণ হবে। গুম হয়ে যাওয়ার পর করোর কারোর লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু তারও চেয়ে দুঃখজনক হল কোনোরকম হদিস না পাওয়া। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য এই পরিস্থিতি দুঃসহ। গুমের মতো দুঃখজনক ঘটনা সমগ্র সমাজকে ভীতির চাদরে মুড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে সমাজ থেকে প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এসবের অব্যাহত নিন্দা জানালেও পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ঘটছে না। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের হালচাল বর্ণনা করতে গিয়ে গুমের মতো ভীতিকর ঘটনাগুলো সর্বাগ্রে মনে আসে। যে সমাজ ও রাষ্ট্র মানুষের জীবনের মূল্যকে যথার্থভাবে পরিমাপ করতে পারে না, সে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভিন্ন মাত্রাগুলোর বিশ্লেষণ নিরর্থক মনে হয়। সরকারকেও মনে রাখতে হবে- এ ধরনের ঘটনার হোতারা সরকারের সুহৃদ হতে পারে না। কারণ এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। আর কিছু না হোক, সরকার তার নিজের ভাবমূর্তি সম্পর্কে অচিরেই সজাগ হয়ে উঠবে এটাই কামনা। সরকারকে মনে রাখতে হবে প্রফেসর রেহমান সোবহানের সেই উক্তিটি : ‘আমার সমালোচক আমার বড় বন্ধু।’ এই উক্তিতে বিশ্বাসী হলে দেশে গণতন্ত্রের জন্য কোনো বিপদ থাকবে না। আমাদের একান্ত কামনা সব ধরনের বিপদ থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিরাপদ হোক। আমরা সবাই মিলে সদ্ভাব ও সম্প্রীতিতে বেঁচে থাকব- এটাই একান্ত কামনা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/1723