১ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ৯:০৮

নির্বাচনের বছরে পুনরাবৃত্তি নয়

আশিকুল হামিদ : অনেক আগে থেকেই ২০১৮ সালকে নির্বাচনের বছর হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। এর মধ্যে গত মাস ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরপর একদিকে ২৮ ডিসেম্বর দেশের ১২৬টি ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে জোর তৎপরতা। এসব কারণেও একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা জমে উঠতে শুরু করেছে। কথায় কথায় আসছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে ক্ষমতাসীনদের একতরফা ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকান্ডের প্রসঙ্গও। কারণ, ওই ‘নির্বাচনে’ ৩০০ আসনের সংসদে ১৫৪ জনই বিনাভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন, বাকি আসনগুলোতেও গণতন্ত্রসম্মত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থে এত পরিষ্কার প্রতারণা সত্ত্বেও ‘নির্বাচিত’ নামের দশম সংসদকেই ‘হালাল’ করা হয়েছে এবং ওইসব এমপির সমর্থনে ‘গঠিত’ সরকার এখনো ক্ষমতায় রয়েছে।

মূলত মাত্র সেদিনের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনমনে সংশয়ের শুধু নয়, আশংকারও সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি জনগণও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তারা ইতিহাসও স্মরণ না করে পারছে না। ইতিহাসের সে পর্যালোচনায় অনিবার্যভাবেই আসছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রসঙ্গÑ সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যে ব্যবস্থাটি আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের পরিচালিত আন্দোলনের ‘ফসল’ ছিল। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের উদ্যোগে সংসদে গৃহীত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের মার্চে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। এতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ। তারও আগে ১৯৯৪ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করেছিল। সে আন্দোলনে প্রধান ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী। উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক বা কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার দাবি মূলত ছিল জামায়াতে ইসলামীর।

ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনার দাবি তুলেছিল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতসহ তখনকার বিরোধী দলগুলো। দাবিটির যৌক্তিকতা নিয়ে সে সময় বিস্তর বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছিল। হরতাল হয়েছিল দিনের পর দিন। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সরকার দাবিটি মেনে নিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করেছিল বিএনপি সরকার। এর ভিত্তিতে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নিজেরা উপকৃত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মনোভাব নিয়ে অবশ্য প্রথম থেকেই প্রশ্ন ও সংশয় ছিল। কারণ, শেখ হাসিনা শুধু একবারের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। তখন বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য ছিল কোনোভাবে একবার ক্ষমতায় যাওয়া এবং তারপর ক্ষমতা স্থায়ী করা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ব্যবস্থাটিকে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছিল। বামপন্থী দলগুলোও জামায়াতের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।

১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের জন্য প্রকাশ্যে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সে সময় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত ভাবতেই পারেননি যে, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে তার দলের ভরাডুবি ঘটবে। ভাবতে না পারার কারণ, নির্বাচনের আগে তার সরকার এমনভাবেই প্রশাসনকে সাজিয়ে গিয়েছিল, যাতে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা না আসতে পারে। অন্যদিকে সেবার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই শেখ হাসিনার সরকার জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। একই কারণে ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ঘটেছিল লজ্জাকর পরাজয়। ওই নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া আবারও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। অন্যদিকে প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামী মন্ত্রিত্ব নিয়েছিল। দলটির আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী হয়েছিলেন।

বিরোধিতা করলেও বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা জনগণের স্বার্থে এমন কোনো ভূমিকা পালন করেননি, যার কারণে জনগণ আবারও তাকে ক্ষমতায় আনার কথা চিন্তা করবে। ২০০৬ সালের নির্ধারিত নির্বাচন এগিয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশি-বিদেশি প্রতিটি জরিপেই বরং আওয়ামী লীগের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানানো হচ্ছিল। তখনই শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র। সে ষড়যন্ত্রের ফলেই ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার ভয়াবহ হত্যা-সন্ত্রাস থেকে নির্বাচন বাতিল করাসহ তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেন ঘটেছিল। সবই আসলে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ঘটানো হয়েছিল। জেনারেল মইন উ আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে সামনে রেখে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্রকেই শুধু বিদায় করা হয়নি, সবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর যে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছিল তার মাধ্যমেও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে বলা যায়, মূলত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার এবং বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোকে উৎখাত করার লক্ষ্যে ওই নির্বাচন ছিল বড় ধরনের একটি পদক্ষেপ। এর সঙ্গে বৃহৎ প্রতিবেশি এবং আরো কয়েকটি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক শক্তি জড়িত ছিল বলে ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে।

দশম সংসদের ওই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা যথেষ্টই হয়েছে। বড় দলগুলোর মধ্যে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে কতটা ন্যক্কারজনকভাবে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল সে কথা স্মরণ করলে বিস্মিত ও স্তম্ভিত না হয়ে পারা যায় না। তা সত্ত্বেও মূলত বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের পাশাপাশি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্য থেকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোট নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধী দলের নেত্রীর আসনও গ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে প্রকৃত ফলাফল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা ছিল বলেই আওয়ামী লীগ সরকার এগিয়েছিল বাঁকা পথে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ওপর ভর করেছিলেন। সরকারের পক্ষে একটি রিট আবেদন পেশ করা হয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার এবং সংবিধানেরও পরিপন্থী। কারণ, গণতন্ত্র ও সংবিধানের চেতনা হচ্ছে, দেশে সব সময় একটি নির্বাচিত সংসদ বহাল থাকবে। নির্বাচিত সরকারই দেশ পরিচালনা করবে। সে রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট হাই কোর্টের তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা হয়েছিল। কারণ, অজুহাত হিসেবে যে রায়কে অবলম্বন করা হয়েছিল সে রায়টি একদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, অন্যদিকে বিতর্কিত হয়েছে স্ববিরোধিতাপূর্ণ হিসেবে। কেননা, রায়ে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি, একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া এটা ছিল একটি বিভক্ত রায়। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত সদস্যের মধ্যে কতজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন এবং তারা ঠিক কি অভিমত দিয়েছিলেন সেকথাও প্রকাশ করা হয়নি। বড় কথা, রায়ের নামে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা আসলে ছিল একটি ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকার সে পদক্ষেপই নিয়েছিল। ক্ষমতাসীনরা সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়া অভিমতটুকুর উল্লেখই করেননি- যেখানে বলা হয়েছিল, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

অমন একটি সংকীর্ণ এবং নিজেদের স্বার্থ পূরণকারী চিন্তার ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়েছিলেন। রাজনৈতিক সংকটের শুরুও হয়েছিল সেখান থেকেই। বিএনপির নেতৃত্বে জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো ওই সংশোধনীর বিরোধিতা করেছে। উল্লেখ্য, ততদিনে ১৮ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। কিছুদিন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানালেও বেগম খালেদা জিয়া এক পর্যায়ে ছাড় দিয়ে বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে এবং শেখ হাসিনা ওই সরকারের প্রধান হতে পারবেন না। জাতিসংঘের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং গণচীনও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহবান জানিয়েছিল। এজন্য প্রধান দুটি দলকে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছিল।

অন্যদিকে সংলাপের নামে একের পর এক নাটক সাজিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। ঘটনাপ্রবাহে সরকারের কূটিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। তা সত্ত্বেও ২০১৩ সালের নভেম্বরে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটকে রাষ্ট্রের প্রধান ‘অভিভাবক’ এবং ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে সম্মানের সঙ্গে উল্লেখ করে মধ্যস্থতা করার এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে ভূমিকা পালনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা থেকে সরকারকে নিবৃত্ত করার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছিলেন তারা। ১৮ দলীয় জোটের নেতারা রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলেন, দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকা সহিংসতাকে প্রতিহত না করা গেলে এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালানো হলে গণতন্ত্র ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। মারাত্মক সে পরিণতির কবল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির উচিত সচেষ্ট হওয়া। জবাবে রাষ্ট্রপতি তার ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ কথা শুনিয়ে বলেছিলেন, ১৮ দলীয় জোটের দাবি ও বক্তব্য তিনি সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন! এর পরপর প্রধানমন্ত্রী একদিকে হঠাৎ করে সংসদের চলমান অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটিয়ে সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন বিধান যুক্ত করার পথ বন্ধ করেছিলেন, অন্যদিকে সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির কথিত ‘অনুমতি’ পাওয়ার খবর জানিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিলেন।

ঘটনাপ্রবাহে ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সদিচ্ছার দিকটিই বেশি গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছিল। কারণ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের সামনে রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীর আড়ালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা নিজের তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন তার ফলে রাষ্ট্রপতির হাত-পাও নাকি বেঁধে ফেলা হয়েছিল! ১৮ দল বলেছিল, কথিত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সংবিধানে এ কথাও বলা আছে যে, রাষ্ট্রপতি যে কোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে ‘পরামর্শ’ দিতে পারবেন। আর রাষ্ট্রপতি যেহেতু ‘মহামান্য’ সেহেতু তার ‘পরামর্শ’ই নৈতিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার তথা সরকারের জন্য ‘নির্দেশ’ হয়ে উঠতে পারে। ওঠা উচিতও। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রপতি এমনকি নৈতিকভাবে চাপও সৃষ্টি করতে পারেন।

উল্লেখ্য, মন্ত্রিসভার বা সংসদের যে কোনো সিদ্ধান্ত বা আইনে অনুমোদন দেয়ার আগে সেটা পুনর্বিবেচনার জন্য তিনবার পর্যন্ত ফেরৎ পাঠানোর ক্ষমতাও সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে রেখেছে। এর ব্যাখ্যায়ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার দিকটিই প্রাধান্যে এসেছিল। সুতরাং একথা ঢালাওভাবে বলার অবকাশ ছিল না যে, রাষ্ট্রপতির হাত-পা বাঁধা এবং কবর ও মাজার জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির আর কোনো কাজ বা ক্ষমতা নেই। ব্যাখ্যার আলোকে বরং বলা হয়েছিল, যা কিছুই লেখা থাকুক না কেন, সাংবিধানিকভাবেই তিনি ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’। একই কারণে বেগম খালেদা জিয়া ও ১৮ দলীয় জোটের নেতারা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন বলা হয়েছিল, এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের উদাহরণও অনুসরণ করতে পারতেন। উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস তখন বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবীসহ নাগরিক সমাজের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তাদের অভিমতের ভিত্তিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রপতির সে ‘পরামর্শ’ অনুযায়ীই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গঠিত ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান যুক্ত করে সংবিধান সংশোধ করেছিলেন। এটাই ছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী।

অন্যদিকে সংঘাত ও হরতালসহ প্রচন্ড সংকটের মুখেও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের উদাহরণ অনুসরণ করেননি। অথচ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতিকে অনুসরণ করা হলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সময়ের বিষয়ে পরিণত হতে পারতো। গণতন্ত্র রক্ষাসহ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই রাষ্ট্রপতির উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীকে এমনভাবে ‘পরামর্শ’ দেয়া যাতে তিনিও বেগম খালেদা জিয়ার মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং ১৮ দলীয় জোটের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করেন। সংসদ তখনও বহাল থাকায় রাষ্ট্রপতি যে কোনো সময় অধিবেশনও আহবান করতে পারতেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি। আর সে সুযোগ নিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন। এর পরই আয়োজিত হয়েছিল এমন এক নির্বাচন, যে নির্বাচনে ১৫৪ জনই বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন!

৫ জানুয়ারির সে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ার সময়ও প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট মারপ্যাঁচ কষেছিলেন। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতির ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা’ সম্পর্কে জানা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গভবনে যাওয়ার এবং রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের কাছে দাবি ও বক্তব্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া শুধু সদিচ্ছারই প্রমাণ দেননি, দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রীর ভূমিকাও পালন করেছিলেন। কারণ, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার হুবহু পুনর্বহালের দাবি পরিত্যাগ করার পাশাপাশি অনেক আগেই তিনি অন্য এমন সব বিষয়ে ছাড় দিয়েছিলেনÑ যেগুলোকে অজুহাত বানিয়ে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক সংকটের সমাধানকে অসম্ভব করতে এবং বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে পারতেন। খালেদা জিয়া শুধু একটি বিষয়ে অনড় থেকেছেন। সেটা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার সম্পর্কিত। এ সরকারের রূপরেখায় তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানের পদে শেখ হাসিনাকে রাখা চলবে না। বিষয়টি নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে যে কোনোস্থানে সংলাপে বসার ব্যাপারেও সম্মতি জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়েছিলেন একতরফা নির্বাচনের নীলনকশা অনুযায়ী। তার বিরুদ্ধে সে সময় সর্বাত্মক উস্কানি দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল। বিদেশীদের পরামর্শ ও আহবানের জবাবেও প্রধানমন্ত্রী অনড় অবস্থানেই থেকেছেন। মুখে সংলাপ ও সমঝোতার কথা বললেও প্রধানমন্ত্রী সে সময় ‘সর্বদলীয়’ সরকারের নামে নিজের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মহাজোট সরকারের সম্প্রসারণ করেছিলেন। রাশেদ খান মেনন প্রমুখ মন্ত্রী রাতারাতি আওয়ামী মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এবং আবারও মন্ত্রিত্ব গ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যেন সত্যিই কোনো ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠন করেছেন প্রধানমন্ত্রী! এই চেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি। কারণ, কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিলেও ক্ষমতাসীনরা দেখাতে পারেননি, প্রধানমন্ত্রীর ওই ‘সর্বদলীয়’ সরকারের বিধান সংবিধানের ঠিক কোন অনুচ্ছেদ বা উপ-অনুচ্ছেদে রয়েছে। অর্থাৎ ‘সর্বদলীয়’ সরকারের ব্যাপারে তারা আসলে সংবিধান লংঘন করেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্যও গোপন থাকেনি। সে উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংবিধানবহির্ভূত এমন একটি ‘সর্বদলীয়’ সরকার গঠন করা, যার মাধ্যমে লোক দেখানো নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসা যাবে।

বাস্তবেও সেভাবেই ক্ষমতায় এসেছিলেন তারা। অথচ উদ্দেশ্যে সততা এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত ছিল অন্তত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে সম্মত হওয়া। বলা দরকার, মূলত বৃহৎ একটি প্রতিবেশির সহযোগিতায় এখনো ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলেও মনোভাবে পরিবর্তন ঘটেনি বলে আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি সমগ্র জাতিকেও নতুন পর্যায়ে প্রচন্ড সংকটের মুখে পড়তে হবে। প্রায় নিশ্চিত এই সংকট এড়াতে হলে ক্ষমতাসীনদের উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে তাদের নীতি ও সিদ্ধান্তে পরিবর্তন ঘটানো। সর্বোচ্চ আদালতকে টেনে আনার এবং বিতর্কিত করার পরিবর্তে তারা যদি বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী ‘সহায়ক’ সরকারের অধীনেও নির্বাচন করতে সম্মত হন তাহলেই সংকট কাটানো সম্ভব হতে পারে।

দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ক্ষমতাসীনদের একগুঁয়েমি ও উস্কানিমূলক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। ‘সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার’ কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিতেই পারেন কিন্তু একথাও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলো এখনো তাকে রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক মনে করে। আর একথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানুষের জন্যই সংবিধান, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এই কথাটার তাৎপর্য অনুধাবন করে ক্ষমতাসীনদের বোঝানোর উদ্যোগ নিলেই তার পক্ষে জাতির স্বার্থে ‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব’ পালন করা সম্ভব হবে। আর সে পথ ধরেই দেশে আবারও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এজন্য এমনকি সংবিধান সংশোধন করারও দরকার পড়বে না। কারণ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘সর্বদলীয়’ সরকারের আড়াল নেয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, দরকার আসলে সদিচ্ছার। ওই অভিজ্ঞতার আলোকেই আশা করা হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে এমন ব্যবস্থা নেয়া হবে যাতে আগামী নির্বাচনে সকল দল অংশ নিতে পারে এবং ওই নির্বাচনে যাতে ৫ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

http://www.dailysangram.com/post/313443