৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৮:৫৭

ইউরোপে পাচারের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশিরা

ভালো চাকরির আশায় দালালের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে লিবিয়ায় গিয়েছিলেন ফারহানা (৩৫)। সেখানে দুই মাস তিনি যে কারখানায় কাজ করেন তার পরিবেশ ও বেতন আগের প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম ছিল।

তৃতীয় মাসেই সশস্ত্র যোদ্ধাদের হামলায় কারখানার কিছু অংশ ধ্বংস হলে কর্তৃপক্ষ কর্মীদের বেতন দেওয়াই বন্ধ করে দেয়। দুইবার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ডাকাতি ও অপহরণের শিকার হন বাংলাদেশি এই নারী।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দেশে না ফিরে ইউরোপে যাওয়ার জন্য ফারহানা আরেক দালালের সহায়তায় ইউরোপে পাড়ি জমান। ইতালি অভিমুখী নৌকায় চড়তে দালালের পেছনে তাঁকে খরচ করতে হয়েছে ৬০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
এ রকম সুনির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনের নামে মানবপাচার ও শোষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশি ও নাইজেরীয়রা। মধ্য ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অভিবাসন পথ নিয়ে আইওএমের তৈরি করা প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এ কথা বলা হয়েছে।

গত সপ্তাহে প্রকাশিত হয় ‘মাইগ্র্যান্টস ভালনারেবিলিটি টু হিউম্যান ট্রাফিকিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেশন : এভিডেন্স ফ্রম সেন্ট্রাল অ্যান্ড ইস্টার্ন মেডিটেরিয়ান মাইগ্রেশন রুটস’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন। এতে আরো বলা হয়েছে, লিবিয়া হয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে পৌঁছাতে বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ১২ লাখ টাকা করে খরচ করছে। এমনকি ৩০ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকাও খরচ করেছে অনেকে।
আইওএমের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের চেয়ে মধ্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মানবপাচার ও শোষণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে, মধ্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ৪৮ শতাংশই পাচার ও শোষণের শিকার। পূর্ব ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পাচার ও শোষণের শিকার হওয়ার হার ৩১ শতাংশ।

পাচার ও শোষণের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশই পশ্চিম আফ্রিকার বাসিন্দা। এ ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে গাম্বিয়া, সেনেগাল ও গায়ানার নাগরিকরা। তবে অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার পথে মানবপাচার ও শোষণের শিকার হওয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়ার অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। আইওএমের প্রতিবেদনে এ ধরনের ৩৪টি ঘটনার কথা বলা হয়েছে।
আইওএমের সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারীদের তুলনায় পুরুষরা এবং তুলনামূলক কম শিক্ষিতরা পাচার ও শোষণের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যাত্রা যত দীর্ঘ হয় পাচার ও শোষণের শিকার হওয়ার শঙ্কা ততই বাড়ে।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে যারা লিবিয়া বা তুরস্কে অবস্থানের পর ইউরোপের পথে পাড়ি জমিয়েছে তাদের তুলনায় পাচার ও শোষণের কম ঝুঁকি ছিল যারা সরাসরি নিজ দেশ থেকে ইউরোপে গেছে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে যারা চেনা-জানা ব্যক্তিদের সঙ্গে ইউরোপের পথে পাড়ি জমিয়েছে তারাও কম ঝুঁকিতে ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশি সংঘাতপূর্ণ দেশ থেকে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পাচার ও শোষণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

আইওএম ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাদের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশই শিশু; যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছর। ওই শিশুদের মধ্যে ৮৬ শতাংশই তাদের পরিবার ছাড়া একাই ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে। পাচার ও শোষণের শিকার হওয়ার ঝুঁকি তাদেরও ছিল। আবার সেগুলো থেকে নিজেদের রক্ষায় সামর্থ্যও তাদের ছিল না।
মধ্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছা শিশুদের অর্ধেকের বেশিই অভিযোগ করেছে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইউরোপে পাঠানো হয়েছে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগর পথে জোরপূর্বক ইউরোপে পাচার করা বয়স্কদের সংখ্যার দ্বিগুণ শিশু ওই পথে পাচারের শিকার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপে যাওয়ার পথে ট্রানজিট বা উৎস দেশ হিসেবে লিবিয়ার নাম এসেছে। ওই দেশটি মানবপাচার ও সব ধরনের শোষণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১১ সালে লিবিয়ায় সংঘাত শুরুর সময় দেশটিতে ৬০ থেকে ৯০ হাজার বাংলাদেশি ছিল বলে ধারণা করা হয়। সংঘাত শুরুর পর বেশ কয়েক হাজার বাংলাদেশি দেশে ফিরেছে। আবার অনেকে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তাছাড়া দেশি-বিদেশি চক্র ইউরোপে পাঠানোর নাম করে বাংলাদেশি কর্মীদের আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে গেছে। এরপর জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করেছে বা সাগরপথে ইউরোপে পাঠানোর জন্য আরো অর্থ দাবি করেছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ আছে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/12/31/583887