৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৮:৫২

চাল নিয়ে চালবাজির বছর

ঘাটতি না থাকলেও চালের দাম বেড়েছে হু হু করে * অবৈধ মজুদ ও কৃত্রিম সংকটে সরকারি ভাবমূর্তিতে টান * মূল্যসন্ত্রাসে হিমশিম খেয়েছে সব শ্রেণীর ক্রেতা * চালের দাম বৃদ্ধিতে গরিব হয়েছে ৫ লাখ মানুষ

চলতি বছর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল চালের মূল্যসন্ত্রাস। এতে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের হাওরাঞ্চলের বাঁধে ধস এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা বন্যায় ধানের ফলন ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব বাজারে পড়ে। সরকারি গুদামে চালের মজুদ স্মরণকালের সর্বনিন্ম পর্যায়ে নেমে যাওয়ায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাল সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কায় সরকার চাল আমদানি উন্মুক্ত এবং আমদানি শুল্ক হ্রাসের উদ্যোগ নেয়। তবে উদ্যোগ সময় মতো না নেয়ায় আমদানি চালের সুফল বাজারে খুব একটা পড়তে দেখা যায়নি। বাজারে চালের ঘাটতি না থাকলেও দাম বেড়েছে হু হু করে। চাল নিয়ে চালবাজি করেছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী।

দেশে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এবং ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধ হওয়ার গুজবে পাইকারি ও খুচরা বাজার চালের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। একই সঙ্গে দুর্বল মনিটরিংয়ের সুযোগে বিভিন্ন মোকাম, চাতাল বা গোপন গুদামে চালের অবৈধ মজুদ গড়ে উঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে অবৈধভাবে মজুদ করা চাল উদ্ধার হয়েছে।
সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা চাল সরবরাহে কৃত্রিম সংকট তৈরি করলেও বাজারে চালের ঘাটতি হয়নি। দাম বেশি হওয়ায় সব শ্রেণীর ভোক্তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম পরিমাণ চাল কিনতে বাধ্য হয়েছে। এভাবে ২০১৭ সালে মূল্যসন্ত্রাস ছড়িয়েছে চাল। চালের মাত্রাতিরিক্ত দাম দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সীমাহীন ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারক পর্যায় ও জাতীয় সংসদেও চালের দাম নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। সংসদ ও সংবাদ মাধ্যমে বাণিজ্যমন্ত্রীকে ব্যাখা দিতে হয়েছে।

যুগান্তরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মোটা চালের দাম ছিল ৩৫-৩৮ টাকা। সেটি সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৫২-৫৫ টাকায় ওঠে। ছয় মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ১৭ টাকা। তবে সরকারের নানা উদ্যোগে জুলাই ও আগস্টে চালের দাম কিছুটা কমে যায়। তখন মোটা চাল ৪৬ ও মিনিকেট ৫৬ টাকায় বিক্রি হয়। সেপ্টেম্বরে মোটা ও চিকন চালের দাম দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মূল্য স্পর্শ করে।
বছরজুড়ে বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মোটা চাল জানুয়ারিতে ৩৮ টাকা ও মার্চে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ সময় মিনিকেট ৫০ থেকে ৫৩ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মোটা চালের দাম এপ্রিলে আরও ২ থেকে ৩ টাকা বেড়ে ৪২ থেকে ৪৩ টাকায় বিক্রি হয়। এ সময় মিনিকেট ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়। মে মাসে মোটা চাল ৪৫ ও মিনিকেট ৫৬ টাকায় বিক্রি হয়। জুনেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। এ সময় মোটা চাল ৪৮ ও মিনিকেট ৫৬ টাকায় বিক্রি হয়। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কেজিপ্রতি দাম বৃদ্ধি পায় ৮ থেকে ১০ টাকা। বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ থেকে ৭২ টাকা। অবশ্য পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নভেম্বর-ডিসেম্বরে চালের দাম কিছুটা কমেছে। এখন বাজারে মোটা চাল ৪৪-৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর একই সময়ে এর দাম ছিল ৩৫-৩৮ টাকার মধ্যে। ৪৬-৫০ টাকার চিকন চাল সেপ্টেম্বর নাগাদ ৬৫ থেকে ৭২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ বছর কেজিপ্রতি ১৯ থেকে ২১ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। ডিসেম্বরে কেজিপ্রতি ৪-৭ টাকা দাম কমেছে। এখন ৫৮-৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর একই সময়ে চিকন চালের দাম ছিল ৪৪-৫৬ টাকার মধ্যে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) ত্রৈমাসিক পর্যালোচনায় বলা হয়, ২১ ডিসেম্বরের হিসাবে চিকন চাল ৫৮ থেকে ৬৮ টাকা, মাঝারিমানের চাল ৪৮ থেকে ৫৬ টাকা ও মোটা চাল ৪৪ থেকে ৪৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সানেম জানায়, বন্যার পাশাপাশি সময়মতো আমদানি না হওয়া এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যার কারণে গত কয়েক মাসে চালের দাম গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর ফলে শুধু চালের দাম বাড়ায় কয়েক মাসে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ গরিব হয়ে গেছে। এসব মানুষ আগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, এখন তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। চালের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী দেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ গরিব। তারা দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে বসবাস করছে। অর্থনীতিবিদদের দাবি, এসব মানুষ খাবার কিনতে যে খরচ করে তার ৮০ শতাংশই খরচ করে চাল কিনতে। সম্প্রতি সচিবালয়ের এক অনুষ্ঠানে চালের দাম বৃদ্ধিকে অসহনীয় বলে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, কৃষকদের সুবিধার জন্য সরকার চালের দাম কিছুটা বাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু চালের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তা অসহনীয়। চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিমাণটা অস্বাভাবিক। মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকার ওপরে উঠায় কিছু লোকের খুব অসুবিধা হয়েছে। দামটা আসলে অনেক বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, আমদানি করার পরও চালের দাম বেড়েছে। এটা উদ্বেগজনক। চালের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমদানি করা চাল সময়মতো বাজারে না আসায় দাম বেড়েছে। পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা ছিল।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. এমকে মুজেরি বলেন, চাল দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রধান খাদ্য। এর দাম অস্বাভাবিক হলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়। এর ফলে কাউকে কাউকে হয়তো সঞ্চয় ভেঙে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। নয়তো কম খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কিছু লোকের আয়ের ওপর চালের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি আঘাত হেনেছে। এখনই সরকারের উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। এ থেকে উত্তরণে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, চলতি বছরের এ সংকট থেকে সরকারকে শিক্ষা নিয়ে আগামী বছরের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কেন চালের দাম বেড়েছে এবং এর নেপথ্যে কোথায় কী ধরনের ত্রুটি গাফিলতি ছিল তার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হবে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ, দায়ীরা চিহ্নিত না হওয়া এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ ঘটনা ঘটছে। চালের মূল্যসন্ত্রাসের কারণে সরকারের অব্যাহত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে মানুষ চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বেশিরভাগ পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও চালের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে চরমভাবে ভুগিয়েছে- এটা এখনও অব্যাহত আছে।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page