৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ২:২৫

প্রেমের শ্রেষ্ঠ উপমা হজরত মুহাম্মদ (সা.)

-প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

বিনিসুতোর বন্ধনই প্রেম। সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক গড়ার অলৌকিক সূত্র এটি। অন্যকথায় প্রেমের আত্মায় মানবতার বসবাস। সত্যিকার প্রেমের পঙক্তি রচনায় তোমার উপমা তুমিই হে প্রিয় রাসূল (সা.)। মানবতার পরতে পরতে যে অসংগতি তার সুচিকিৎসায় তোমার প্রেয়ময় ক্ষমা ও সৌন্দর্যবোধ পরিপূরক নেয়ামত। মানব শিশুর ভ্রুণ তৈরির পূর্ব থেকেই তোমার যে প্রেমপরশ তা মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে শৈশব-কৈশর-যৌবন ও পৌঢ়কাল পেরিয়ে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। মানবতাবাদী সেøাগানের খোলসে যে নারকীয়তা, তার জ্বালাময়ী উদর দেখেছি আইয়্যামে জাহেলিয়াত থেকে একাবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানময় বিশ্বের আধুনিকতা পর্যন্ত। প্রেমের মোড়কে বিকানো সব আদর্শেই বিষধর সাপ, আগুনের লেলিহান শিখা। ফলে শুধু টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এবং রূপসা থেকে পাথুরিয়া নয়, বিশ্বের প্রত্যেক জনপদেই হাহাকার, ফিরে আসে শান্তির মুখোশ। তাই এ প্রেক্ষাপটে শুধু তোমাকেই মনে পড়ে। এ মনেপড়া শুধু বিশ্বাসী হৃদয়েই নয়, অমুসলিম বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানীরাও তোমায় স্মরণ করে টমাস কালকাইলের মতো। তোমার বিপ্লব ছিল এক প্রচ- অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যা দিল্লি থেকে গ্রানাডা এবং দুনিয়া থেকে আসমান পর্যন্ত যে অমানবিকতা ও অসত্যের আবর্জনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তা চোখের নিমিষে পুড়ে ছারখার করে দিল। তাই তো তোমাকে আবার চায় এ পৃথিবী।

ফিরে দেখা মনুষ্যত্বের ধ্বংসস্তুপের ওপর নতুন পতাকা হাতে মানবতার কা-ারি হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। অজ্ঞতা, বর্বরতা ও স্বেচ্ছাচারিতার দাপটে মানবতা যখন ভূলুণ্ঠিত, তখনই তাঁর আগমন। ভাইয়ে ভাইয়ে, বোনে-বোনে, পিতা-পুত্রে, ঘরে-বাইরে, সমাজে-অর্থনীতিতে; এমনকি ধর্ম বিশ^াসেও শুধু দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের খবর। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এ নীতি যেমন সর্বত্র বিরাজমান, তেমনি ‘নারী, মদ ও যুদ্ধ’ নেতৃত্বের শীর্ষতম গুণাবলী। সমাজের অর্ধেক নারী হলেও তারা ছিলেন ভোগের সামগ্রী মাত্র। যখন যাকে যেভাবে ইচ্ছে ভোগ করতো ক্ষমতাবান পুরুষরা। নিজেরা যথেচ্ছা নারী ভোগে লোলুপ থাকলেও নিজের বংশের মান বাঁচাতে স্বীয় কন্যাকে স্বহস্তে জীবন্ত কবর দিতেও দ্বিধাবোধ করতো না। শত্রুর সাথে গলাগলি তো দূরের কথা, দাস-দাসী থেকে শুরু করে পরিবারের প্রিয়জন পর্যন্ত নিষ্ঠুরতার স্বীকার হতো। মূলত তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের জ্ঞান না থাকার কারণে মানবতাবোধের এত অবক্ষয়। এ কারণে ঐতিহাসিকগণ এ সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়া নামে অভিহিত করেছেন। আলোহীন পৃথিবী, আঁধারের ঘোরতর মহকাল, মানবতার প্রান্তসময়।

মানবতা ও প্রেম

রাতের পরে দিনের আলো যেমন প্রত্যাশিত বাস্তবতা, সেই বাস্তবতার নিরিখে মহানবী (সা.) এলেন অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির আবাদ করতে। এলেন তিনি অহির বারতা এবং প্রেমের অথৈই সাগর বুকে ধারণ করে মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে। স্বস্তি ফিরে আসে আকাশে-বাতাসে, সৃষ্টির পরতে পরতে নেমে আসে প্রশান্তির ছোঁয়া। প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে আশাহত শিশু কিশোর, সুখের স্বপ্ন দেখে ঘর পোড়া দম্পতি, আলোয় বেরিয়ে আসে অন্ধকারে থাকা নারী সমাজ; বাঁচার স্বপ্ন দেখে দাস-দাসী এবং সমাজের অস্পৃশ্য মানবমইম-লী।
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’। এ বাস্তবসত্যকে সামাজিকভাবে ফলপ্রসূ করার জন্য বর্তমানে শিশু অধিকার নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা সেøাগান। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে শিশু অধিকার দিবস ঘোষণা করা হলেও দিন যত গড়াচ্ছে শিশু অধিকার ততই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। অথচ অনেক আগেই শিশু অধিকার নিশ্চিতকল্পে মহানবী (সা.) নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। মহানবী (সা.) যখন কোনো সওয়ারীতে আরোহণ করতেন, তখন আগে-পিছে শিশুদের তুলে নিতেন এবং পথিমধ্যে খেলাধুলারত শিশুদের আদর সোহাগ করাকে তাহাদের অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং পুত্র-কন্যা উভয় শিশুকেই সমভাবে স্নেহ মমতা করার আদেশ দিয়েছেন। শিশুদের বিভিন্ন ক্রটি-বিচ্যুতি অপরাধ হিসেবে না দেখে মমতা মাখা আদরে তা সুধরে দিতেন। তিনি শিশুদের শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়াকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং উত্তম সদকা বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা সঠিক শিক্ষা না পেলেই শিশু-কিশোররা বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ পায়; বিশেষত কিশোর বয়ঃসন্ধিক্ষণে অপরাধজগৎ তাদের রঙিন স্বপ্নে হাতছানি দেয়। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন শিশু-কিশোর অধিকারের মূর্তপ্রতীক।
একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের যৌবনামুহূর্তে প্রেম, মানবতাবোধ, মানবাধিকার, প্রগতিশীলতা প্রভৃতি শব্দগুলো ব্যাপক আকর্ষণীয় রঙে উপস্থাপিত হচ্ছে। আধুনিকতার প্যাকেজ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন তৈরিতে ভীষণভাবে ব্যস্ত বিজ্ঞানের স্বপ্নময়ী নির্মাতাগণ। এ স্বপ্নের দোলায় দুলতে দুলতে আমরাও জীবনের বাস্তবতার উপভোগ্যতা হারিয়ে সর্বক্ষণ স্বপ্নের মতো দৌড়াচ্ছি। নতুন নতুন যন্ত্রের সাথে আমরাও হয়ে যাচ্ছি জীবন্ত রোবট। হঠাৎ সম্বিত ফিরে আসে হজরত আজরাঈল (আ.)-এর ডাকে। কিন্তু কিছুই করার নেই। শুধু টিকিট সংগ্রহই নয়, ওপারের বাহনে উঠে যাত্রা শুরু। পরপারের বাস্তবতায় নয় পৃথিবীবাসীর বিশ্লেষণেই আমার প্রেম প্রমাণিত হলো স্বার্থবাদী হিসেবে, মানবতাবোধ চিহ্নিত হলো নিজের সুখ-শান্তি ধরার ফাঁদ হিসেবে। মানবাধিকার উপস্থাপিত হলো অন্যের অধিকারের নাম করে নিজের আয়েশি জীবন পাওয়ার মুখোশ হিসেবে এবং দুর্গতি ও দুর্দশাগ্রস্ত-দুর্গতিময় সামাজিক অবকাঠামো গড়ার বাহন হিসেবে। প্রমাণিত হলো প্রগতিশীলতা। তাহলে কি পেলাম এ রঙিন সেøাগানে নিজেকে উচ্চকিত করে? ‘ভালোবাসার শেষ ফল, বুকে ব্যথা চোখে জল’ সে জলটুকুও মিলবে কি? তাই মানবতাবাদী মহাপুরুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শের কাছে ফিরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?

নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে পৃথিবীতে মানুষের আবাদ হলেও, নারীরা স্মরণাতীতকাল থেকেই নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়ে এসেছে। মোসাঃ আউয়ালন্নেসা খাতুনের পরিভাষায় ‘যুগ যুগ ধরিয়াই নিরীহ নারী জাতি উপেক্ষিতা, নিগৃহীতা জীবনযাপন করিয়া আসিতেছিল। এই লাঞ্ছিতা, পদদলিতা অবলা জাতিকে সসম্মানে ধুলা মুছিয়া সর্বপ্রথম যে গৌরবের কোলে ঠাঁই দিয়াছে তাহা হইতেছে, ন্যায়নিষ্ঠ, উদার ও মহান এবং শান্তিময় ইসলাম।’ মুহাম্মদ আহবাব চৌধুরীর মতে, ইসলামই সর্বপ্রথম উপেক্ষিত নারীকে মঙ্গলময়ী নারী বলে অভিনন্দিত করে। এ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মঙ্গলময়ী নারী, এসো অনন্দময়ী নারী, এসো তাপসময়ী নারী বলে মাতৃজাতিকে অভিবাদন জানান। হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পত্তি, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অধিকার প্রদান করে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করলেন। সত্যিকার অর্থেই মহানবীই (সা.) সর্বপ্রথম নারীকে পুরুষের সমপর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করে তাকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’ এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে মাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর বাণী, তোমার পালনকর্তা আদেশ দিচ্ছেন যে, তাকে (আল্লাহকে) ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে ভালো আচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদের ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের সাথে ধমকের সুরে কথা বলো না এবং তাদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করো। তাদের সাথে ভালোবাসা সহকারে নম্রভাবে মাথা নত করে দাও।

অত্র আয়াতে পিতা মাতার সমঅধিকার ও মর্যাদা সূচক বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু অন্য আয়াতে মায়ের মর্যাদাকেই বেশি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়াতে সময় লেগেছে ৩০ মাস। মহানবী (সা.) পিতা-মাতা উভয়কেই সন্তানের জান্নাত অথবা জাহান্নাম বলে উল্লেখ করলেও অনেক হাদীসেই মায়ের গুরুত্ব বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল (সা.) আমার সুন্দর আচরণের সবচেয়ে বেশি হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা। (বুখারী ও মুসলিম)। মহানবী (সা.) নারীকে বড় বড় পাপ থেকে নিষ্কৃতি লাভের উসিলা হিসেবেও উপস্থাপন করে তাদের মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছেন। এক ব্যক্তি প্রিয়নবীর (সা.) খেদমতে হাজির হয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)! আমি একটি বড় গুনাহ করে ফেলেছি, হে রাসূল (সা.) আমার তাওবার কোনো পথ আছে কি? রাসূল (সা.) বললেন তোমার মা জীবিত আছেন কি? সে ব্যক্তি বলল, জ্বি না হুজুর, মা জীবিত নেই। অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন, তোমার খালা জীবিত আছেন? লোকটি বলল, জী হুজুর খালা জীবিত আছেন। রাসূল (সা.) বললেন, তার সাথে সুন্দর ও মাধুর্যপূর্ণ আচরণ কর। সুতরাং শুধু মা হিসেবেই নয়, খালা হিসেবেও ইসলাম নারীকে কত বড় উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে এ হাদীস থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
সমতা বিধানে মহানবী (সা.) অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি পরামর্শের ভিত্তিতে কার্য সম্পাদনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মহিলাদের বিবাহের ক্ষেত্রেও এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কুমারী, বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তাসহ সব মহিলার বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলাম তাদের সম্মতিকে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে মূল্যায়ন করে থাকে। মহানবী (সা.) বলেছেন, তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা নারী তার বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভিভাবকের তুলনায় অধিক হকদার এবং কুমারীর বিয়ের ব্যাপারেও তার অনুমতি নিতে হবে। বিয়েতে পাত্রীর অনুমতির গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি তাদের মর্যাদাকে বৃদ্ধির জন্য পাত্র কর্তৃক মোহরানা প্রদানকেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ প্রাক-ইসলামী যুগে কন্যা পক্ষের অভিভাবক কর্তৃক বরপক্ষকে মোহরানা (ডিমান্ড বা উৎকোচ) প্রদান করতে হতো। ইসলাম এ ঘৃণ্য প্রথাকে উচ্ছদ করে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে মোহর পরিশোধ করা ফরজ করে দিয়েছে। শুধু মোহর দেয়াই শেষ নয়, বরং দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সাথে ভালো আচরণ করতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা নারীদের সাথে সৎভাবে জীবনযাপন করো। যদি তাদের তোমরা অপচ্ছন্দ করো, তবে হয়তো তোমরা এমন এক জিনিষকে অপছন্দ করছÑ যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন। অনুরূপ মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, পূর্ণাঙ্গ ঈমানদার তারাই, যাদের আচার-আচরণ ভালো, আর তোমাদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম, যারা তাদের স্ত্রীদের কাছে সর্বোত্তম। (তিরমিযী) সুতরাং স্ত্রীদের স্বামীর চরিত্র নির্ণয়ক মাপকাঠি হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়েছে। জাহেলি যুগে নারীদের অবমূল্যায়ন করার ফলে ইসলাম তাদের এতটা গুরুত্ব দিয়েছে, কারো যদি ২টি সন্তান থাকে তার একটি যদি কন্যাসন্তান হয়, তবে বাজার থেকে সন্তানদের জন্য কোন মিষ্টান্ন কিংবা ভালো জিনিস বাড়িতে আনা হলে আগে কন্যাসন্তানের হাতে তুলে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া কন্যাসন্তানের লালন-পালনকে জান্নাত লাভের উসিলা হিসেবেও দেখানো হয়েছে। মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ২টি কন্যাসন্তানকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, আমি এবং সে একত্রে জান্নাতে বসবাস করব। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, যার একটি কন্যাসন্তান রয়েছে এবং তাকে জীবন্ত কবর দিল না, তার সাথে অপমানজনক কোনো আচরণ করল না এবং তার তুলনায় কোনো পুত্রসন্তানকে অধিক অনুগ্রহ দেখালো না, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করবেন। কন্যার পাশাপাশি বোনের পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারেও মহানবি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি তার দুই বোনকে ভরণ পোষণ দেবে, আমি এবং সে আখিরাতে এক সাথে মিলিত হব।’ সুতরাং প্রমাণিত হয়, ইসলাম নারী অধিকার খর্ব করেনি, বরং ইসলাম এবং ইসলামই নারী অধিকারের একমাত্র জীবন বিধান।

এ কথা নির্মম সত্য যে, একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের যুগে এসেও আমরা ঘুরেফিরে আবার সেই জাহেলি যুগেই ফিরে যাচ্ছি। আধুনিকতার মোড়কে নারীদের পণ্য বানানো হচ্ছে। মিডিয়া ও বিনোদনে নারীকে সাজানো হচ্ছে ভোগের সামগ্রী হিসেবে। নারী অধিকারের ভোকাল সেøাগানিস্টরাই কন্যাসন্তান রোধে কন্যা ভ্রƒণ হত্যায় চ্যাম্পিয়ন খেতাব অর্জন করছে। ভারতের মতো মানবতাবাদী ও নারী অধিকারের প্রবক্তা বলে পরিচয়দানকারী রাষ্ট্রে দৈনিক প্রায় ৩ হাজারের অধিক কন্যা ভ্রƒণ হত্যা করার খবর অনেক পুরনো। এমনকি তামিলনাড়– ও রাজস্থানের মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রে বড় বড় পোস্টার ও প্রচারপত্রে সেøাগান তোলা হয়েছে ৫০০ রুপি খরচ করুন, ৫ লাখ রুপি বাঁচান। অর্থাৎ ৫০০ রুপি খরচ করে আলট্রাস্নোগ্রাফি করে নিশ্চিত হোন পেটের সন্তান ছেলে না মেয়ে। মেয়ে হলে তাকে হত্যা করে তার ভরণপোষণ ও যৌতুকের ৫ লাখ টাকা বাঁচান। জাহেলি যুগের কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবরদানের আধুনিক রূপ নয় কি এটা? অথচ মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, যে পিতা একটি অথবা দু’টি অথবা তিনটি কন্যাসন্তান সন্তুষ্টচিত্তে লালন-পালন করে সুশিক্ষা দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে সে পিতা-মাতা এবং আমি জান্নাতে পাশাপাশি অবস্থান করবো। তিনি আরো বলেছেন, কন্যাসন্তান তোমার জান্নাতের উসিলা এবং জাহান্নামের বাধা। পবিত্র কুরআনেও বলা হয়েছে, স্ত্রীরা তোমাদের পোশাক পুরুষরাও তাদের পোশাক।

শুধুমাত্র সমাজের সাধারণ নারীই নয়, বরং বিধবা নারীরা ছিল সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তাদের সমাজের এতটাই বোঝা মনে করা হয়েছিল, তারা বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুকেই বেশি সহজ ও কল্যাণকর মনে করত। মহানবী (সা.) বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে তাদের সামাজিক মর্যাদার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) ছাড়া তাঁর সমস্ত স্ত্রীগণই বিধবা ছিলেন। তিনি বিধবা ও এতিমদের সম্পর্কে ঘোষণা করেন, যে কেউ কোনো বিধবা ও এতিমের (মিসকিনের) কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট থাকে সে আল্লাহর পথে জিহাদরত কিংবা ঐ ব্যক্তির সমতুল্য যে দিনে রোজা রাখে এবং সারারাত ইবাদতে কাটায়, (তিরমিযী)। অথচ আধুনিক বিশ্বেও বিধবা নারীগণ সামাজিকভাবে বঞ্চনার শিকার। মাত্র একশত বছর পূর্বেও দাস-দাসীগণ ছিলেন সমাজের সবচেয়ে অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী। মনে করা হতো, দাস-দাসীদের মনিবের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তারাও যে মানুষ এ ধারণাই করা হতো না। মহানবী (সা.) প্রথম শ্রেণী বিভেদ দূর করলেন এবং দাস-দাসীগণকে মানবসমাজের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি দাসদের আজাদ করে তার পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘দাস-দাসীগণও তোমাদের মতোই মানুষ এবং তোমাদেরই ভ্রাতা, ভগ্নি বা তাহাদিগকে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তোমরা নিজেরা যা খাও তাহাদিগকে তাই খাওয়াও, নিজেরা যা পরিধান কর তাহাদিগকে তাই পরিধান করাও এবং তাহাদিগকে সাধ্যের অধিক কাজ দিবে না, যদি দিতেই হয় তবে নিজেরাও সহায়তা করবে।’ অথচ বর্তমান বিজ্ঞানময় আধুনিক সমাজে দাস-দাসী না থাকলেও বাড়ির কাজের বুয়া, গেন্দু কিংবা ছোট ছোট বাচ্চাদের বাসাবাড়ির কাজে নিয়োগ করে তাদের প্রতি কেমন আচরণই বা করা হয়? যারা বেশি প্রগতিশীলতার ধারক-বাহক, শিশু অধিকার সম্পর্কে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ঘরের কাজের শিশুটিই বেশি অধিকার বঞ্চিত। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিদের ঘরেই কাজের বুয়া কিংবা কাজের শিশুরা বেশি নিগৃহীত হয়, নির্যাতিত হয়; এমনকি জীবননাশের মতো ঘটনাও ঘটে।

ঘোষণাপর্ব

এ প্রেক্ষাপটে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করা যায়, কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতাদর্শ নয়, শুধুমাত্র মহানবীর (সা.) আদর্শই পারে মানুষকে মানবতাবোধে উজ্জীবিত করতে। তিনি নন আরবে কিংবা অনারবের, শুধু আমিরের, নন শুধু ফকিরের। তিনি একক কারো নন, তিনি সবার; সব মানুষের। মানতাবাদের যে ফসিল আমাদের সামনে ঝুলানো হচ্ছে এগুলো আলেয়া কিংবা রঙিন ফানুস বৈ কিছু নয়। তাই দ্বিধাহীনচিত্তে বলতেই পারি, হে মুহাম্মদ (সা.)! তুমিই মানবতাবাদী প্রেমিক মহাপুরুষ; তোমার পরশেই এ অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির মশাল জ্বলে উঠতে পারে। তোমার আর্দশের ছোঁয়ায় এ সবুজ জমিনে বয়ে যাক সুখ-শান্তির বহতা নদী; প্রেম ও মানবতাবাদের স্রোতে প্লাবিত হোক মানবজমিন। পৃথিবী এখন তোমার আদর্শের দিকেই তাকিয়ে।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

mrakhanda@gmail.com