৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১:২৮

গুমের সাথে সম্পৃক্ত কারা

ড. আবদুল লতিফ মাসুম: এক টুইট বার্তায় প্রধান বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দাবি করেছিলেন, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সরকার ৭৫০ জনকে গুম করেছে। এর প্রতি উত্তরে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছিলেন, ‘তার (বেগম খালেদা) কাছে আমরা প্রতিটি ঘটনার নাম, বর্ণনা, কোথায় কী হয়েছিল, কোন সরকারি সংস্থা জড়িত এটা দাবি করব। এটা যদি না বলতে পারেন, তাহলে আমরা বলব তিনি মিথ্যা-ভ্রান্ত তথ্য ছড়াচ্ছেন এবং জনমনে আশঙ্কা-শঙ্কা তৈরি করছেন।’ উল্লেখ্য, প্রদত্ত বক্তব্যে বেগম খালেদা জিয়া ২০১৩ সালে ‘কালো’ দিবসে গুম হওয়া ১৯ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে গুম, অপহরণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে জোরপূর্বক তুলে নেয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো অসংখ্যবার এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করেছে। বিষয়টি সরকার বা বিরোধীদলীয় নয়, জনগণ এর ভুক্তভোগী। সুতরাং কারা এই গুম-অপহরণ করছে তা খতিয়ে দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধীরা বলছে, সরকার এ কাজটি করছে। সরকারের উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিষয়টি শুধু অস্বীকারই করেননি, বরং তিনি প্রধান বিরোধী নেত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তাহলে এ ঘটনাগুলো কারা করছে? 
অপরাধকে লঘু করা আওয়ামী সরকারের একটি রেওয়াজ। সরকারপ্রধান বলেছেনÑ ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চত্যে ব্যাপকভাবে গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘গুম-অপহরণ এ দেশের একটি অনেক পুরনো বিষয়।’ এটি অসত্য নয় যে, অনেক লোক নিজে থেকেই গুম হয়ে যায়। মামলাবাজ লোকেরা শত্রুকে ঘয়েল করার জন্য নিজেদের লোককে গুম করে রাখে। পাওনাদারের ভয়ে লুকিয়ে যায় কেউ কেউ। জঙ্গি তৎপরতায় অংশগ্রহণের জন্য কোনো কোনো যুবক গুম বা লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। আজকাল গুম বা অপহরণ করে জিম্মি করে অর্থ আদায়ের ঘটনা যত্রতত্র ঘটছে। গুমের ব্যাপকতা দেখে মনে হয়, সম্ভবত কিছু লোক এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ সব কিছুই স্বাভাবিক। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অস্বাভাবিক উক্তি হলো, সরকারকে বিব্রত করার জন্য নিজেই বা অন্য লোকেরা কিছু লোককে গুম করে ফেলছে। গুমের কারণ যাই হোক না কেন, সব কিছুর জন্য সরকারকেই দায়ী হতে হয়। কারণ সাধারণ নাগরিকের জীবন, সম্মান ও সম্পত্তি রক্ষার দায়দায়িত্ব পৃথিবীর সব সরকারই স্বীকার করে। স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক কিংবা কারা সরকারকে বিব্রত করার জন্য এসব করছেÑ সেটা প্রমাণ করার দায়িত্বও সরকারের। সরকারের দায়দায়িত্ব হেঁয়ালিভাবে অন্যের কাঁধে তুলে দেয়া যায় না। 
সরকারের দায়িত্ব গুম, অপহরণ বা জোরপূর্বক তুলে নেয়ার বিষয়টি উদঘাটন করা। কোথায়, কারা, কী কারণে এসব ঘটাচ্ছে তা তদন্ত করা। কিন্তু বিগত প্রায় এক দশকে ক্ষমতাসীন সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি নিয়ে ছিটেফোঁটা মন্তব্য করা ব্যতীত তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কিংবা তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। আমাদের নামকাওয়াস্তে একটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। সভ্য রাষ্ট্রের খাতায় নাম তোলার জন্য কমিশনটি গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে একে কোনো কার্যকর ক্ষমতা দেয়া হয়নি। পৃথিবীর অন্যত্র গুম-খুন অনুসন্ধানে কার্যকর সংস্থা থাকলেও আমাদের দেশে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। টাকার জন্য গুম-অপহরণ হলে পুলিশকে কখনো কখনো তৎপর হতে দেখা যায়। কিন্তু যখন গুমের সাথে রাজনীতির সংযোগ থাকে বা বুদ্ধিবৃত্তির স্পর্শ থাকে তখন আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই নীরব থাকে। উদাহরণ হিসেবে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, সালাহউদ্দিন ও ফরহাদ মজহারের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত গুম হয়ে যাওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান, সাংবাদিক উৎপল দাশ, ব্যাংকার শামীম আহমেদ, সরিষাবাড়ীর মেয়র রোকনুজ্জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় এবং কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমানের অপহরণ এবং অবশেষে প্রত্যাবর্তন নতুন রহস্যময়তা সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথিত ব্যক্তিগত শত্রুতা, জিম্মি করে অর্থ দাবিÑ এসব কিছুই ঘটেনি। তাহলে এসব অপহরণের কারণ কী? কারা এই অপহরণকারী? কী ছিল তাদের উদ্দেশ্য-বিধেয়? এসবই নাগরিক সাধারণের সামনে বড় বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ ২৬ ডিসেম্বর ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তা নাইমুল ইসলাম সৈকতের নিখোঁজের খবর পাওয়া গেছে।
প্রতিটি ঘটনা যদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে কোনো বাস্তব ও বোধগম্য উত্তর পাওয়া যাবে না। ১. মোবাশ^ার হাসান একজন শিক্ষক। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সুনামের সাথে সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তিনি ইতোমধ্যেই সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। কেউ কেউ সন্দেহ করছেন যে, তার গবেষণার বিষয় অপহরণের কারণ হতে পারে। আর এটা যদি সত্যি হয় তাহলে বোঝা যায় বিষয়টি গতানুগতিক নয়, বরং এমন কিছুর ইঙ্গিত দেয় যা জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। দীর্ঘকাল ধরে পত্রপত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে তৎপর। খোদ সরকার ‘আইএস আছে আইএস নেই’ প্রসঙ্গে একটি বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করেছিল। একটি পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের ২২ আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ পর্যন্ত খোদ ঢাকা শহরে মোবাশ্বার হাসানসহ মোট ১২ জন নিখোঁজ হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন ঘরে প্রত্যাবর্তন করে। পুলিশ তিনজনকে আটকের কথা অবশেষে স্বীকার করলেও বাকি চারজনের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। তবে এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রায়ই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের খবর পাওয়া যায় অথবা লাশ পাওয়া যায় ঝোপঝাড়, খানাখন্দক অথবা খালবিলে। ২. একই কায়দায় ফেরত আসেন ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়, সাংবাদিক উৎপল দাশ, ব্যাংকার শামীম আহমেদ ও সরিষাবাড়ীর মেয়র রোকনুজ্জামান। তাদের প্রায় সবার ঘটনা একই রকম। একই স্টাইলে তাদের অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীরা অর্থ দাবি করেছে। মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা কে কত টাকা দিয়েছে অথবা দেয়নি এটি স্পষ্ট নয়। তার কারণ হয়তো মুখ খুললেই বিপদ আছে। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাদের ভাষ্য থেকে মনে হয়েছে, নিছক অর্থই অপহরণকারীদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাহলে কী ছিল তাদের উদ্দেশ্য? ৩. এ ছাড়া নবগঠিত জনতা পার্টির সভাপতি মিথুন চৌধুরী এবং অন্য আরেকজন নেতা আশিষ ঘোষকে সাদা পোশাকের পুলিশ সূত্রাপুর এলাকা থেকে ২৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে। অবশ্য পুলিশ দাবি করে, এ দু’জনকে তারা নভেম্বরের ১৩-১৪ তারিখের দিকে গ্রেফতার করে। এ ছাড়া একজন বই আমদানিকারক তানভীর ইয়াসিন করিমকে সাদা পোশাকের পুলিশ তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার করে নভেম্বরের ৮ তারিখে, অথচ পুলিশ বলছে তারা আসলে তাকে গ্রেফতার করেছে নভেম্বরের ১৯ তারিখে। শুধু এ তিনজন নয়, অসংখ্য অভিযোগ আছে এ রকম। এ তিনজনকে ভাগ্যবান বলতেই হবে। কারণ পুলিশ অন্তত তাদের গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেছে। দেশের সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে অথবা সাদা কাপড়ে অসংখ্য লোককে গ্রেফতার করেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে অসংখ্য মামলা হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীদের ধারণা, পুলিশ গ্রেফতারকৃতকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সমর্পণের বাধ্যবাধকতাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ওই অসত্য তথ্য প্রদান করছে। যেসব ক্ষেত্রে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ অথবা অন্য কিছু ঘটছে, সেসব ক্ষেত্রে কাউকেই জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত পরিষ্কার করে বলছে, তারা কাউকে গ্রেফতার করেনি বা এ সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। নিরাপদ উত্তর। ৪. প্রায় চার মাস নিখোঁজ থাকার পর কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমানকে অবশেষে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের মিছিলে বোমা হামলার মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে। গত ২৩ ডিসেম্বর আমিনুরকে আদালতে উপস্থাপন করে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এত দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব পর্যায় থেকে অস্বীকার করা হচ্ছিল যে, তারা আমিনুরকে গ্রেফতার করেনি। গত ২৭ আগস্ট কল্যাণ পার্টির কার্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হন আমিনুর রহমান। পরিবারের পক্ষ থেকে পল্টন থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হলেও তার কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছিল না। এই চার মাসের নাটকীয়তার জবাব পাওয়া যায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার এ রকম ভাষ্যেÑ ‘আমিনুর নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তারা খোঁজখবর করছিলেন। হঠাৎ শুক্রবার আমিনুরের ফোনটি খোলা পাওয়া যায়। তারপরই পুলিশ তাকে গুলশানের শাহজাদপুর থেকে উদ্ধার করে। তিনি কোথায় ছিলেনÑ এমন প্রশ্নের জবাব আমিনুর দিতে পারেননি।’ সুতরাং ‘বুঝহ হে সুজন’। ৫. একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি অপ্রিয় সত্য তুলে ধরেছেন। এক সেমিনারে তিনি স্বীকার করেন, পুলিশ এ ধরনের কাজ করছে। একটি ঘটনা উল্লেখ করেন, একজন প্রশিক্ষণরত চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের সন্দেহ, তিনি চট্টগ্রাম নৌবাহিনীতে বোমা হামলায় জড়িত দু’জনকে আশ্রয় দিচ্ছেন। ৩০ ঘণ্টা পর গ্রেফতারকৃত ডাক্তারকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেন, এ ধরনের ঘটনায় ব্যক্তি থেকে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করা হয়। সব সময় সব কিছু প্রকাশ করা যায় না। পুলিশ জানে, অপরাধ আইনের ৬১ ধারা মোতাবেক তারা এ ধরনের আচরণ করতে পারেন না। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের গ্রেফতারের বিষয়ে উচ্চ আদালতের কড়া নির্দেশনা রয়েছে। 
এ বিষদ বিশ্লেষণের পরে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কারা গুম, খুন, অপহরণ ও জোরপূর্বক তুলে নিচ্ছে। তিনি এটাও বোঝার চেষ্টা করবেন কোথায়, কিভাবে এসব ঘটনা ঘটছে। আশা করি এটাও পরিষ্কার হয়েছে যে, কারা আশঙ্কা বা শঙ্কার মধ্যে দেশকে নিক্ষেপ করেছে। তিনি যদি পরিসংখ্যান চান, তাহলে প্রতিদিন সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে পারেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে অসাধারণ লোকেরা যতই বোকা মনে করুক না কেন তারা এত বোকা নয়। সরকার উটপাখির মতো বালুতে মুখ লুকালেও প্রলয় বন্ধ হবে না। আব্রাহাম লিংকনের একটি বিখ্যাত উক্তি উল্লেখ করে উপসংহার টানতে চাইÑ ‘You can fool all the people some of the time, and some of the people all the time, but you cannot fool all the people all the time.’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
Mal55ju@yahoo.com


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/280657