৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১:২৫

শিক্ষামন্ত্রীর তোলপাড় তোলা বক্তব্য এবং ঘুষ-দুর্নীতির খণ্ডচিত্র

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : দুর্নীতি, চুরি, ঘুষ, অনিয়ম এসব নিয়ে কথা বলে বা লেখালেখি করে কোনও লাভ হয় না আজকাল। পেশাই এটা তাই লেখি। এসব নিয়ে বহুবার বহুভাবে লেখেছি। আগে কিছুটা কাজ হলেও এখন হয় না। সংশ্লিষ্টদের কানে পানি যেতো। এখন যায় না। তবু লেখি। পেশার কারণে লেখতে হয়। এ বাজে পেশাটা ছেড়ে দিলে আর হয়তো লেখতে হবে না। 
শিক্ষামন্ত্রীর তোলপাড় তোলা বক্তব্য নিয়ে যখন লেখবো লেখবো করছিলাম, ঠিক তখনই নদীখনন নিয়ে অনিয়ম ও লুটপাটের একটি বড় খবর অনলাইন মিডিয়াতে পেলাম। তাই শিক্ষামন্ত্রীর চুরি ও ঘুষ বিষয়ক আলোচনার ভেতর নদী ড্রেজিংয়ে সাগর চুরির বিষয়টি অযাচিতভাবে এসে গেল। একটার ভেতর আরেকটা ঢোকায় মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তবে বিষয় কিন্তু একই। চুরি, ঘুষ, অনিয়ম ইত্যাদি। 
আমাদের দেশটি নদীবহুল। অভিন্ন নদীগুলোতে ভারত কর্তৃক বাঁধ, গ্রোয়েনসহ বড় বড় প্রকল্প নির্মিত হওয়ায় আমাদের দেশের অভ্যন্তরে নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। পলি বা বালি জমে অনেক নদী গেছে প্রায়ই মরে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ অনেক নদী যেমন অনাব্য হয়ে পড়েছে, তেমনই এসব নদীতে নৌযান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। তাই এসব নদী বাঁচিয়ে এবং নৌ চলাচলের উপযোগী করে রাখতে ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হয়। এজন্য খরচও হয় প্রচুর অর্থ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ, নদী ড্রেজিংয়ে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। নদীভেদে ব্যয়ের পার্থক্যও অনেক বেশি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বড় নদীর চেয়ে ছোট নদীর ড্রেজিং ব্যয় বেশি ধরা হচ্ছে। ফলে প্রতিবছর নদী ড্রেজিং কার্যক্রমের খরচ বাড়ছে। প্রকাশ, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে যমুনা নদীতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় পড়ছে ১০ কোটি চার লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অথচ ফরিদপুরের আড়িয়াল খাঁয় ড্রেজিংখাতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রায় আড়াই গুণের কাছাকাছি। 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন নদীর পেছনে ড্রেজিং কাজে অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এমনকি ড্রেজিং কাজের জন্য বিদেশী উন্নয়ন সংস্থা বা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও ঋণসহায়তা নেয়া হয়। বাংলাদেশে ছোট-বড় ও মাঝারি মিলে প্রায় সাড়ে ৭০০টি নদী রয়েছে। কিন্তু ড্রেজিং ও অপরিকল্পিত ইন্টারভেনশনের কারণে দেশের প্রায় ২৩০টি নদীই এখন মৃত। বর্তমানে নদীগুলো পলিউশন, সিলটেশন, তীরদখল, ব্লকেজ ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার বেশির ভাগ শিল্প নদীর তীর ঘেঁষে স্থাপন করায় প্রতিদিন প্রায় ১০০ টন শিল্পবর্জ্য নদীতে পড়ছে বলে নদীরক্ষা কমিশনের এক তথ্যে জানা যায়।
পরিকল্পনা কমিশনে দেয়া প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ফরিদপুর জেলার আড়িয়াল খাঁর তীর সংরক্ষণ ও ড্রেজিং প্রকল্প ২৯৭ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সম্পূর্ণ সরকারি ব্যয়ে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এখানে ৫ দশমিক ৩৮০ কিলোমিটার নদীতীর সংরক্ষণ কাজ এবং ৬.৩০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করা হবে। এর পাশাপাশি ঘাট নির্মাণ করা হবে ১০টি।
এ প্রকল্পে ৬.৩০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিংয়ের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪৬ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। আর প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এটাকে অত্যধিক বলে অভিমত প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোটনদী বিবেচনায় এই ব্যয় অনেক বেশি। যেখানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে যমুনা নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে ৮ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় প্রাক্কলিত হয় ১০ কোটি টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নির্ধারিত রেট শিডিউল অনুযায়ী এ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্য দিকে নদী ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পে যেখানে বাঁধ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় প্রতি কিলোমিটারে ৩০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, সেখানে আড়িয়াল খাঁর ৫ দশমিক ৩৮০ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৪০ কোটি ৭৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় পড়বে ২৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রতি মিটারে প্রাক্কলন করা হয়েছে দুই লাখ ৬২ হাজার টাকা। এ ব্যয়ে বিরাট ফারাক কেন? কে দেবে এর জবাব?
দুর্নীতি এদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলেছে। এমন কোনও সেক্টর নেই যেখানে ঘুষ নামক মহাদানবের অস্তিত্ব নেই। উল্লেখ্য, ঘুষ খাওয়ার কথা এখন মাননীয় মন্ত্রী সাহেবরা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে শুরু করেছেন। একবার আমাদের মালমন্ত্রী বলেছিলেন, ঘুষ হচ্ছে ‘স্পিড মানি’। মানে এটা দিলে কাজ দ্রুত সম্পন্ন হয়। এবার মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী স্বীকার করলেন, ‘শুধু অফিসাররাই চোর না। মন্ত্রীরাও চোর। আমিও চোর।’ মানবজমিন: ২৫-১২-১৭। প্রকাশ্যে চোর হবার কথা স্বীকার করবার জন্য মাননীয় মন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেয়াই হয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি কথা বদলে ফেলেন। দায় চাপান আগের সরকারের ওপর। 
আরেকটা কথা মনে রাখা উচিত। সেটা হচ্ছে, চুরি ও ঘুষের মধ্যে কিন্তু ফারাক আছে। শিক্ষামন্ত্রী যা বলেছেন সেটা চুরির কথা। আর মালমন্ত্রী বলেছিলেন ঘুষের কথা। মালসাহেব ঘুষের নাম দেন স্পিড মানি। কেউ কেউ বলেন, 'উপরি'। আর আমরা যে কথা বলতে চেষ্টা করছি, সেটাকে বলে চুরি। খোদ শিক্ষামন্ত্রী যেটা বলেছেন। কথায় আছে, ‘চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা।’ ধরবে কে? শিক্ষামন্ত্রীও ঘুষ নেবার কথা বলেন। তবে সীমিত মাত্রায় নিতে বলেন তিনি।
হ্যাঁ, ড্রেজিংয়ের নামে নদীভেদে যে বরাদ্দ এবং এর বিরাট ফারাক তা কেবল চুরি নয়, পুকুরচুরি। না পুকুর কেন? বলা যায় ‘সাগরচুরি’। এখন পুকুরটুুকুর চুরি হয় না। চুরি হলে সাগরই হয়।
মজাটা হচ্ছে, নদী ড্রেজিং করতে হয় পানির তলে তলে। বিশেষ ব্যবস্থা ব্যতীত ওপর থেকে বোঝা মুশকিল কোন দিকের বালি বা মাটি কোন দিক গেল এবং কোন দিকে কতটুকু ফেলা হলো। আবার এক দিকে বালি সরিয়ে দেবার পর অন্যদিক থেকে কতটুকু এসে সে খালি জায়গা ভরাট হয়ে গেল তার হিসেব রাখাও দুরূহ। কাজেই সংশ্লিষ্টরা যা বলবেন বা হিসেব দেবেন তাইতো মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ পানির নিচে যতো ড্রেজিং হবে ততো চুরির সুবিধে। এজন্যই হয়তো বরাদ্দের ফারাক হয় ভিন্ন ভিন্ন। আর ফাঁকফোকর রেখেই যে বরাদ্দ দেয়া হয় না, তাইবা কী করে নিশ্চিত হওয়া যায়? ঘটনাতো সবই পানির নিচে। তবে বরাদ্দকৃত অর্থ মারিংকাটিং হয় ওপরেই। অংশ থাকে অনেকেরই। এমনকি শিক্ষামন্ত্রীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মন্ত্রীদেরও। কাজেই দুষবেন কাকে?
ব্যাংকের টাকা লুটপাট হচ্ছে। ধরা পড়ছে কেবল চুনোপুঁটিরা। রাঘববোয়ালদের ধরে সাধ্য কার? সরকারি ব্যাংকের মূলধন প্রায় শেষ। এখন নজর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দিকে। এসব থেকেও মারতে মারতে প্রায় ফতুর হবার উপক্রম। আমানতকারীদের লাভতো হয়ই না। মূলধনেও টান পড়তে শুরু করেছে। কাজেই দেশের আর্থিক খাত এখন ভীষণ নড়বড়ে। ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা নেই।
চুরি আর অর্থ পাচারের ফলে দেশের মেরুদ- ভেঙে পড়ছে। কেউ কাউকে পরওয়া করছেন না। যে যেভাবে পারছেন আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। দেশ গোল্লায় যাক, লুটেরাদের তাতে কী? তাদেরতো অর্থ বিদেশি ব্যাংকে জমা হচ্ছে। বাড়িও উঠছে আমেরিকা, কানাডা কিংবা মালয়েশিয়ায়। যাদের সবকিছু বিদেশে, এদেশের জন্য তাদের মমত্ব থাকবে কেন? যতোটা পারছেন লুটেপুটে পাচার করে দিচ্ছেন। নদী ড্রেজিং কিংবা ফ্লাইওভার নির্মাণ যাই বলুন, সবখানে বরাদ্দের অঙ্ক বিরাট। তাও একবার দুবার নয়, বারবার বরাদ্দ বাড়িয়ে খরচ কয়েক গুণ করা হয়। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের কথাই ধরুন। বারবার গড়া হচ্ছে। ভাঙা হচ্ছে। বরাদ্দ বাড়িয়ে কয়েক গুণ করা হচ্ছে। মিডিয়ায় এসব অনিয়ম-অপকর্ম সম্পর্কে লেখালেখি এবং নিউজও হচ্ছে হিউজ। কিন্তু কারুর কিচ্ছু হচ্ছে না। হবে কেন? সংশ্লিষ্টদের গোড়াতো খুব মজবুত এবং ওপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।
কাজেই কারুর কোনও ভয় নেই। সবাই শঙ্কাহীন। নিশ্চিন্ত। অনিয়ম, দুর্নীতি করে কেউ ভয় পান না। চুরিটুরি এখন কোনও সমস্যা নয়। মন্ত্রীরা সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন, এটা নাকি অফিসাররা করেন। মন্ত্রীরা করেন। শিক্ষামন্ত্রী নিজেও করেন বলে জানিয়েছিলেন। তাই তিনি চুরিটুরি, অনিয়ম, দুর্নীতি বা ঘুষের বিরুদ্ধে কিছু বলবার সাহস হারিয়েছেন। তবে ঘুষ নামক উপাদেয় খাদ্যটা তিনি ‘সহনীয় মাত্রায়' খেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে বদহজম না হয়। 
শিক্ষামন্ত্রী স্বীকার করেছিলেন তিনি চোর। অন্য মন্ত্রীরাও তাঁর মতো। তিনি শিক্ষা কেডার কর্মকর্তাদের সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তি এবং ঘুষগ্রহণের পরামর্শে কেউ কেউ খুশি হলেও তা কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য খুশির খবর ছিল না মোটেও। বরং ছিল অবমাননাকর ও যারপর নেই লজ্জাজনক। তাই মন্ত্রীর কথায় তোলপাড় শুরু হয়। একটা ঢেউ জাগে। তবে খুব দ্রুতই সে ঢেউ সামলাতে মন্ত্রীকে উদ্যোগ নিতে হলো। যাই হোক, এমন অমর্যাদাকর অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ একান্তই জরুরি। এভাবে কোনও দেশ ও জাতি সামনে এগোতে পারে না। 
উল্লেখ্য, শিক্ষামন্ত্রী নাকি অন্য মিন করে ওসব কথা বলেছিলেন। তিনি স্যাটায়ার করেছিলেন মাত্র। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এমন দাবি করা হয় প্রথমে। পরে গত ২৭ ডিসেম্বর বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে মন্ত্রী জানান, তাঁর বক্তব্য খণ্ডিত আকারে মিডিয়ায় উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি যা বলেছিলেন তা সবই ঘটেছিল বিএনপি-জামায়াতের সময়। মন্ত্রী এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দ্রুত চলে যান। তবে টিআইবি মন্ত্রীর আগের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তাঁর পদ ছেড়ে দেবার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু তা কি আর হয়!

http://www.dailysangram.com/post/313178-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A7%9C-%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%98%E0%A7%81%E0%A6%B7-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0