৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১:২৩

চোরাই কঙ্কালেই ভরসা মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের

দেশে অনুমোদিত সব পাঠ্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণই বৈধ; মানুষ সাধারণত তাই জানে। তবে আশ্চর্য হলেও সত্যি—যাঁরা নিজেদের শিক্ষা দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচান, সেই চিকিৎসকদের শিক্ষার অপরিহার্য এক উপকরণই অবৈধ বলে বিবেচিত হচ্ছে যুগের পর যুগ।

এক রকম চুরি করে আনা উপকরণ কেনেন শিক্ষার্থীরা। প্রকাশ্যে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে (সরকারি-বেসরকারি) শিক্ষকরা শেখান সেই চোরাই উপকরণ দিয়েই। আর সেই উপকরণটি হচ্ছে মানুষের কঙ্কাল। তবে উন্নত বিশ্বের আদলে দেশে এখনো সিম্যুলেটর (প্রতিরূপ) ব্যবহারের প্রচলন বাড়লে এই আসল কঙ্কাল ব্যবহারের প্রয়োজন কমে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, চিকিৎসা শিক্ষার অন্যতম অপরিহার্য উপকরণ হচ্ছে কঙ্কাল। কিন্তু বাংলাদেশে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের জন্য এই কঙ্কাল ব্যবস্থাপনা, সংগ্রহ কিংবা শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের কোনো নীতিমালা আজও হয়নি। ফলে সব সময়ই এই উপকরণ সংগ্রহে চলে লুকোচুরি। তবে বিদেশে আসল কঙ্কালের পরিবর্তে বহু আগে থেকেই সিম্যুলেটর ব্যবহার শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও এখন সময় এসেছে ওই প্রযুক্তির আশ্রয় নেওয়া, তবেই কঙ্কাল নিয়ে সমস্যা কেটে যাবে।

ওই চিকিৎসা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যখন শিখেছি তখন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা এত ছিল না। সাধারণত নিজ নিজ মেডিক্যাল কলেজে বেওয়ারিশ লাশ থেকে ডোমরা কঙ্কাল বের করে ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিক্রি করত। আমরা তাদের কাছ থেকেই কিনতাম। এখন ছাত্রছাত্রী বেড়ে যাওয়ায় কঙ্কাল সংকটও বেড়েছে। অনেকে ভাগে কিনছে; একেকজন একেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিনে গ্রুপ করে শিখে নেয়। অনেকে অবশ্য প্লাস্টিকের কঙ্কাল ব্যবহার করছে।

শিক্ষার্থীরা জানান, সারা দেশের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আগামী ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে ক্লাস। আর ক্লাস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবার ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন হবে বই-খাতা-কালম, অ্যাপ্রোনসহ পড়াশোনার জন্য আনুসঙ্গিক জিনিসপত্র। কিন্তু এসবের পাশাপাশি অ্যানাটমির ক্ষেত্রে মানবকঙ্কালও প্রয়োজন হয় তাদের। বিষয়টি প্রথম বর্ষ এবং দ্বিতীয় বর্ষে প্রয়োজন। অনেকে পুরনো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করার পরও আরো চাহিদা থেকে যায়। আর এ চাহিদা পূরণের কৌশল হিসেবে একটি চক্র পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে চোরাই পথে দেশে আনছে কঙ্কাল। আর সেগুলো বিক্রি হচ্ছে উচ্চ দামে। তবে এখন দেশে কৃত্রিম কঙ্কাল পাওয়া যাওয়ায় অনেকে তা কিনে নিচ্ছে।

ঢাকার সরকারি মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সামিউল ইসলাম সাদী কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেকেই সিনিয়র শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাড় সংগ্রহ করে থাকে। এ ছাড়া কৃত্রিম কঙ্কালও চালু হয়েছে। তাই ধীরে ধীরে আসল মানবকঙ্কাল ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কমে আসছে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের জন্য আগের চেয়ে চাহিদা বাড়ছে। যারা চোরাপথে বিদেশ থেকে আনছে তারা ওই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করেই আনছে।

তিনি বলেন, মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের কাছে কঙ্কাল অন্য শিক্ষা উপকরণের মতো একটি অপরিহার্য উপকরণ। তবে এখন বিশ্বজুড়েই মেডিক্যাল শিক্ষায় মানবকঙ্কাল ব্যবহার বাদ দিয়ে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে।

রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান জানান, তিনি এবার পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী। কিন্তু পাঁচ বছর আগে তিনি যখন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন একটি মানবকঙ্কাল সংগ্রহ করতে তাঁকেও হিমশিম খেতে হয়েছিল। শেষে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একজন দালালের মাধ্যমে একটি কঙ্কাল সংগ্রহ করতে পারেন তিনি। এরপর নিয়মিত অ্যানাটমি বিষয়ে ক্লাস করতে পারেন ওই শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কঙ্কাল সংগ্রহ না হওয়ার আগে তাঁকে তাঁর এক বন্ধুর কক্ষে গিয়ে ওই বিষয়ে পড়াশোনা করে আসতে হতো। এভাবে প্রতিবছর নতুন শিক্ষার্থীরা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই কঙ্কালের অভাবে নানা ভোগান্তির মুখে পড়েন। আবার কঙ্কাল পেলেও অনেকেই উচ্চ দামের কারণে টাকার অভাবে প্রথম দিকে সংগ্রহ করতে পারেন না বলেও দাবি করেন ওই শিক্ষার্থী।

রাজশাহীর একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এ বছর ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী ১০ জানুয়ারি থেকে আমাদের ক্লাস শুরু হবে। ওই দিন থেকেই একটি মানবকঙ্কালের প্রয়োজন হবে। কিন্তু আমি এখনো তা সংগ্রহ করতে পারিনি টাকার অভাবে। এমনিতেই ভর্তির সময় ভর্তি ফি, সেশন ফিসহ বইপত্র কিনতে কয়েক লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এর ওপর এখন ৫০-৬০ হাজার টাকার নিচে মানবকঙ্কাল নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এখনো কঙ্কাল সংগ্রহ করতে পারিনি। ’

আরেক শিক্ষার্থী জাকিয়া বিনতে নূর বলেন, ‘একজন দালালের মাধ্যমে একটি কঙ্কালের ওর্ডার দিয়ে সংগ্রহ করেছি। তবে এর জন্য দিতে হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। অথচ বৈধ উপায়ে পাওয়া গেলে এটি হয়তো বড় জোর ২০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত। কিন্তু দেশে কঙ্কালের বাজার অবৈধ হওয়ায় এটি কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। ’

রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের শিক্ষক মহিবুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে দেশেই কঙ্কাল সংরক্ষণ এবং বাজারজাতের বৈধ ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু এটা এ দেশে প্রায় অসম্ভব। এর জন্য বিদেশ থেকে যেসব কঙ্কাল চোরাই পথে আসছে, সেগুলো আসার জন্য বৈধতা দিতে হবে। তাহলেই কঙ্কাল নিয়ে আর জটিলতা থাকবে না। শিক্ষার্থীরা একটা নির্দিষ্ট দামের মধ্যেই এটিকে বৈধ উপায়ে সংগ্রহ করতে পারবে। এতে করে তাদের আর হয়রানির মধ্যেও পড়তে হবে না। আবার কঙ্কালের অভাবে পড়াশোনারও বিঘ্ন ঘটবে না। ’

রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক আ ন ম মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কঙ্কাল সংরক্ষণ ও বাজারজাতের জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আবার শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে মৃত্যুর পরে দেহ দানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। তা ছাড়া বিদেশ থেকে বৈধ উপায়ে কঙ্কাল আমদানির অনুমতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের হয়রানি থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। আর এসব ব্যবস্থা না নিলে দিনের পর দিন কঙ্কাল নিয়ে এমন অব্যবস্থাপনা চলতেই থাকবে।

অন্যদিকে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা ছয়ফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, গত ২৪ ডিসেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ৯টি মানবকঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত শুকুর আলী চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/news/2017/12/30/583404