৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১:১৯

বছরের আলোচিত চরিত্র চাল

ঘটনার ঘনঘটা। নানা তত্ত্ব, নানা উপদেশ। রাজকারবারিদের কেউ স্বীকার করেন, কেউ করেন না। হয়তো ‘সামান্য’ অনেক জিনিস তাদের জীবনকে স্পর্শ করে না। তারা ব্যস্ত নিজস্ব বয়ানের ইতিহাস তৈরিতে। একপক্ষের বয়ানে দেশ এখন স্বর্গ।

অন্যপক্ষ মনে করে, এই দেশটা এখন নরকে পরিণত হয়েছে। যেন সব সুখ তাদের  আমলেই ছিল। তারা অবশ্য সেসময় সুখেই ছিলেন।
সে যাই হোক, ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়। বিদায়ের শব্দ। দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর। ২০১৭ সালে নানা ঘটনা আলোড়িত করেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে। তবে নিশ্চিতভাবেই সাধারণ মানুষের জীবন, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে চাল। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন যে খরচ তার প্রায় ৮০ ভাগই চলে যায় চাল কিনতে। আর পরিবারের সদস্যদের জন্য সেই চাল যোগাতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হয়েছে পরিবারের কর্তা-ব্যক্তিকে। সকাল-বিকাল যারা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর করে বেড়ান তাদের কথা অবশ্য আলাদা। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংস (সানেমের) সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক মাসে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ গরিব হয়ে গেছেন। আগে তাদের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকলেও এখন তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন। সানেম বলছে, গত ২১শে ডিসেম্বরের হিসাবে চিকন চালের দাম ৫৮ থেকে ৬৮ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৪৮ থেকে ৫৬ টাকা ও মোটা চালের দাম ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যথারীতি সানেমের এ প্রতিবেদন অস্বীকার করেছেন। তবে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে সে সত্য তিনি অস্বীকার করেননি। 
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন সারা দুনিয়ার জন্যই রীতিমতো এক বিস্ময়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনেক বাঘা বাঘা দেশকেও টেক্কা দিচ্ছে। সামাজিক সূচকেও উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু এ সত্যও অস্বীকার করার জো নেই যে, মানুষে মানুষে অসমতা আরো বাড়ছে। অর্থ জমা পড়ছে একটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণির পকেটে। দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে এখনো প্রতিনিয়ত তহবিল হিসাব করে খরচ করতে হয়। একটু এদিক সেদিক হলেই তাদের নাভিশ্বাস শুরু হয়ে যায়। চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি তাই ভিলেন হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে। গতকালও এক চাল বিক্রেতা বলছিলেন, দামবৃদ্ধির কারণে অনেকে আগে যে চাল কিনতেন এখন আর তা কিনছেন না। মধ্যবিত্ত আগে মিনিকেটের মতো চাল কিনলেও এখন তারা অভ্যস্ত হচ্ছেন মোটা চালে। 
চাল নিয়ে অতীতেও অনেক ওয়াজ শোনা গেছে। চালের বদলে আলু খাওয়ার পরামর্শ কাউকে কাউকে দিতে দেখা গেছে। যদিও বাংলাদেশের মানুষ সে পরামর্শ গ্রহণ করেনি। ভালো-মন্দ যাই হোক, খাদ্যাভ্যাস খুব সহজে পরিবর্তন করা যায় না। যারা এসব পরামর্শ দেন বা দিতেন তারা হয়তো অনেক বাস্তবতা থেকেই দূরে। সপ্তাহ খানেক আগের ঘটনা। স্পট কাওরানবাজার। দুটি মেয়ে। বয়স ২০-২৫। দেখে মনে হয়, কর্মজীবী। কয়েকটি দোকানে তারা পিয়াজের দাম জিজ্ঞেস করেন। বিক্রেতারা কেউ বলছিলেন ১১৫ টাকা, কেউবা ১২০ টাকা কেজি। মেয়ে দুটি একে অন্যের দিকে তাকায়। মুখে অসহায়ের ছাপ। এ যেন বাংলাদেশের আরো লাখ লাখ মানুষের অসহায়ত্বেরই ছবি।  
সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালের শুরুর দিকে মোটা চালের দাম ছিল কেজি প্রতি ৩৮-৪০ টাকা। গত মে মাসে তা ৫০ টাকায় উঠে ছিল। নানা উদ্যোগের ফলে নভেম্বরে তা কমে ৪০-৪২ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহে দাম কেজিতে আবার ২-৩ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ টাকায়। অথচ বাজারে আসছে নতুন চাল। গত ১১ মাসে বাংলাদেশে চালের দাম বেড়েছে সাড়ে ৩০ শতাংশ। সরকারি হিসাবেই দেশে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। চালের এই দরও দেশের মধ্যে নতুন রেকর্ড ছিল।  টিসিবি’র বাজারদরের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, এক মাসে সরু চালের দাম বেড়েছে ২-৩ টাকা। বর্তমানে সরু চালের কেজি ৫৮-৬৮ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৫৬-৬৫ টাকা। উন্নতমানের নাজির ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৫ টাকা। বর্তমানে এই চালের কেজি ৬৪-৬৮ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৬০-৬৫ টাকা। আর মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪ টাকা। বর্তমানে এই মানের চালের কেজি ৪৪-৪৬ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৪০-৪৫ টাকা। আর বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ, সাধারণ মানের মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৩০.৩৪ শতাংশ। আর উন্নতমানের মিনিকেটের দাম বেড়েছে ২৬.৯২ শতাংশ। মোটা চাল স্বর্ণা/চায়না, ইরির দাম বেড়েছে ২৩.২৯ শতাংশ।
চালের বাইরে সাধারণ মানুষের জন্য ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পিয়াজ। এক বছরে পিয়াজের দাম বৃদ্ধি  পেয়েছে ২৩৮.৪৬ শতাংশ। গত অক্টোবর থেকে পিয়াজের দাম বাড়া শুরু করে। সেপ্টেম্বরে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দেশি পিয়াজ দাম বাড়তে বাড়তে অক্টোবরে ৮০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৮০-৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় দেশি পিয়াজ। কিন্তু নভেম্বরের শেষদিকে তা ১০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলে। একপর্যায়ে পিয়াজের দাম ১৩০ টাকায় পৌঁছায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে বছরে প্রায় ২০-২২ লাখ টন পিয়াজের চাহিদা রয়েছে। 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=98280