৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১:১৩

নামেই আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার

খালিদ সাইফুল্লাহ:  প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দু’টি আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর আড়াই বছর পার হলেও এখনো পর্যন্ত স্থায়ী জনবলই নিয়োগ দিতে পারেননি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। পরীক্ষাগার দু’টির জন্য প্রায় এক বছর আগে কোটি টাকা ব্যয়ে দু’টি রেফ্রিজারেটর গাড়ি কেনা হলেও ব্যবহার না হওয়ায় অযত্ত-অবহেলায় তা পড়ে রয়েছে। প্রকল্প থেকে পাওয়া গাড়িরও অপব্যবহার চলছে। এ পর্যন্ত দেশের কোনো আলোচিত খাদ্যসামগ্রীর মান পরীক্ষা করতে পারেনি পরীক্ষাগার দু’টি। অথচ আইএসও সনদ লাভে মরিয়া হয়ে উঠেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। 
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহযোগিতায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন আরবান পাবলিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ইউপিইএইচএসডিপি) অধীনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এলাকায় ২০১৫ সালে অক্টোবরে দু’টি আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার চালু হয়। এর মধ্যে ডিএসসিসির নগরভবনের কাছে পুরনো খাদ্য পরীক্ষাগারকে তিনতলা থেকে পাঁচতলা এবং চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় তিনতলাবিশিষ্ট একটি আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হয়। এতে এক বছরে নির্মাণ খরচ বাবদ ৪৯ কোটি টাকা ও দুই বছরের সার্ভিস বাবদ আরো ১৪ কোটি টাকা মিলে ৬৩ কোটি টাকার বাজেট ধরা হয়। প্রকল্পের কাজ পায় মেসার্স এফ আনডুস নামে জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান। জার্মানির এ প্রতিষ্ঠানের পে তাদের এ দেশীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্টার্লিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেড কাজটি বাস্তবায়ন করে। 
আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণের উদ্দেশ্য হিসেবে তখন প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, জনগণের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভেজাল ও গুণাগুণ নির্ণয়ে পরীাগার দু’টিতে জার্মানি থেকে আমদানি করা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞ বিশ্লেষক দিয়ে বিভিন্ন খাদ্য ও পানির গুণাগুণ, ভেজাল ও বিশুদ্ধতা পরীা করা যাবে। যার ফলে দেশবাসীর নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। দেশে খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে উঠবে। আরো বলা হয়, দু’টি গবেষণাগার নির্মাণের পর দেশের সব সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরিদর্শক ও খাদ্যনিরাপত্তা কর্মকর্তাদের আধুনিক যুগোপযোগী প্রশিণ দেয়া হবে। এ জন্য ঢাকায় পরীক্ষাগারের সাথে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও নির্মাণ করা হয়। প্রশিণের যাবতীয় আয়োজন নির্মাতারাই করবেন, তারাই প্রশিণ দেবেন। তারা এক বছরের মধ্যে পরীক্ষাগার নির্মাণ শেষ করার পর দুই বছরের সার্ভিস দেবেন। দ জনবল গড়ে তোলার পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সব বুঝিয়ে দেবে। এতে যে ব্যয় হবে তা প্রকল্প চুক্তির মধ্যেই ধরা আছে। পরীক্ষাগার পরিচালনার জন্য যে দ জনবলের প্রয়োজন হবে তা তারাই ব্যবস্থা করবে ও বেতনভাতাও তারা বহন করবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণের পর দুই বছরের সার্ভিস সময়ও শেষ হয়েছে গত জুনে। তারপরও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো সার্ভিস অব্যাহত রেখেছে। আগামী জুন পর্যন্ত তাদের সার্ভিসের মেয়াদ বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে। এরপর ডিএসসিসি ও চসিককে পরীক্ষাগার দু’টি বুঝিয়ে দেয়া হবে। জানা যায়, বর্তমানে খাদ্য গবেষণাগার দু’টিতে ৩৯ কর্মী কাজ করছেন। যারা সবাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ দেয়া। এসব কর্মচারী পরীক্ষাগারে কাজ করলেও যে মানের দক্ষ জনবলের প্রয়োজন তা নিয়োগ দেয়া হয়নি। প্রকল্পের পক্ষ থেকে গত দুই বছর আগে ৩৯ জন জনবলের একটি অর্গানোগ্রাম (জনবল কাঠামো) তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর এখনো তা অনুমোদন পায়নি। ফলে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জনবল এখনো নিয়োগ দিতে পারেনি। ফলে আগামী জুন মাসের মধ্যে অর্গানোগ্রাম অনুমোদন না হলে আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার জনবলশূন্য হয়ে পড়বে। তা ছাড়া শেষ সময়ে নিয়োগ দেয়া হলেও তাতে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পাবেন না। এ ছাড়া ঢাকার পরীক্ষাগার থেকে সারা দেশের খাদ্য পরিদর্শকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার যে কথা ছিল তাও সুদূরপরাহত। 
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, যেসব খাদ্যসামগ্রী বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রফতানি হয় তাদের ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর স্টান্ডারাইজেশন (আইএসও) সনদ দেয়ার জন্য এ আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হয়েছে; কিন্তু জানা যায়, খাদ্য পরীক্ষাগার দু’টি এখনো নিজেরাই আইএসও সনদ পায়নি। বর্তমানে এটি পাওয়ার জন্য চেষ্টা চলছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে সিটি করপোরেশনের দেয়া কিছু নমুনা পরীক্ষা করলেও দেশে প্রচলিত খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো পরীক্ষাই চালাতে পারেনি খাদ্য পরীক্ষাগার দু’টি। জনগণকে খাদ্যে ভেজালের অপকারিতা সম্পর্কে নিয়মিতভাবে অবহিত করার কথা থাকলেও তা-ও করতে পারেনি। ফলে বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয়ে দু’টি আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হলেও গত আড়াই বছরে তা দেশবাসীর কোনো উপকারে আসেনি। কবে নাগাদ এটি জনগণের উপকারে আসবে তা নিয়েও সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। 
জানা যায়, জনসাধারণ খাদ্য পরীক্ষাগার থেকে কোনো উপকার না পেলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ঠিকই নানা সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। প্রকল্পের জন্য তিনটি মাইক্রো বাস কেনা হয়েছে, যার দু’টি ঢাকা ও একটি চট্টগ্রামের জন্য। ঢাকার দু’টির মধ্যে একটি গাড়ি ট্রেনিং সেন্টারের জন্য কেনা হয়েছে। ট্রেনিং সেন্টার চালু না হলেও গাড়ি ঠিকই ব্যবহার করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির খাদ্য পরীক্ষাগারের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া দু’টি পরীক্ষাগারের জন্য প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল আকারের দু’টি রেফ্রিজারেটর গাড়ি কেনা হয়েছে, যা এক বছর ধরে কোনো কাজে আসছে না। নগরভবনে অযতœ-অবহেলায় পড়ে থেকে গাড়ি দু’টি নষ্ট হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরীক্ষাগারের কর্মকর্তারা জানান, যে আকারের গাড়ি কেনা হয়েছে তা অপ্রয়োজনীয়। এ গাড়ি নগরীর অলিগলিতে নিয়ে যাওয়া যায় না। এত বড় গাড়ি কেনায় বিশাল অংশের কমিশন পাওয়ার মনোভাব কাজ করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। 
এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল খালেক নয়া দিগন্তকে বলেন, একটি অর্গানোগ্রাম তৈরি করে সিটি করপোরেশন হয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এটি অনুমোদন হলে স্থায়ী দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে। তখন এ পরীক্ষাগার দু’টি থেকে সফলতা পাওয়া যাবে। গত আড়াই বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো খাদ্যসামগ্রী পরীক্ষা করা হয়নি বলেও জানান তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/280579