৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১:০৯

ফার্স্ট কাস পাওয়া শিক্ষার্থীর রাত কাটছে রাজপথে

মেহেদী হাসান:  জাহাঙ্গীর আলম ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ এমএসসি পাস করেন। এসএসসি, এইচএসসি থেকে শুরু করে অনার্স, এমএসসি সবগুলোতে প্রথম শ্রেণী লাভ করেন তিনি। জীবনে যত প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন সবগুলোতে লিখিত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেও কোথাও চাকরি হয়নি তার। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় জাহাঙ্গীর আলম আজ রাজপথে রাত কাটাচ্ছেন। তিনি ১৪ বছর ধরে বেতন ছাড়া চাকরি করছেন একটি হাইস্কুলে। বেতনের দাবিতে চার দিন ধরে নন-এমপিও শিক্ষকদের সাথে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে দিন-রাত পার করছেন জাহাঙ্গীর। 
এমপিওর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে সাক্ষাৎ হয় জাহাঙ্গীর আলমের সাথে। সাক্ষাৎকার নেয়া অন্য অনেক শিক্ষকের মতো জাহাঙ্গীর আলমের কাছে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানতে চাওয়া হয় কোন স্কুল থেকে এসেছেন। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লিখবেন আমার কথা? সে অনেক দুঃখের কাহিনী ভাই। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত মুখ। ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত থেকে আন্দোলন করেছিলাম। ভালো ছাত্র হওয়ায় প্রাইভেট পড়িয়ে ভালো আয় করতাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর অনেক প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হয়েও চাকরি পাইনি ঘুষ না দেয়ার কারণে। আমাদের ছিল পাঁচ ভাই দুই ও বোনের সংসার। ঘুষ দেয়ার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। ইচ্ছাও ছিল না। ২০০৩ সাল থেকে পটুয়াখালীর কলাপড়ায় অবস্থিত হাজী আব্দুস সোবহান শিকদার মডেল একাডেমির সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরি করে আসছি বিনা বেতনে। এক দিন এমপিও হবে, অবস্থার পরিবর্তন হবে এ আশায় আশায় এতটা বছর পার হয়ে গেল কিন্তু আজ অবধি আমাদের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি। আমাদের অনেক ছাত্র অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, বেতন পায়। কিন্তু আমরা বেতন পাই না। সে দিন চাকরি পাওয়া এক ছাত্র আমাকে দেখে কেঁদে ফেলে। সে বলল স্যার, আমরা বেতন পাই কিন্তু আপনাদের এখনো বেতন হয় না এটা কিভাবে সহ্য করি। 
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার বৃদ্ধ মা-বাবা আছে। তাদের জন্য কোনো অর্থ খরচ করতে পারি না। ছেলেমেয়ের জন্য কিছু করতে পারি না। কোনো মতে শাকভাত খেয়ে দিন চালাই। এবার তাই নিয়ত করেছি দাবি আদায় না করে ঘরে ফিরব না। প্রয়োজনে এখানে থেকে মরব। কিন্তু পরিবার পরিজনের কাছে আর এ মুখ নিয়ে ফিরে যাবো না বলে জানালেন ৫০ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর আলম। 
শুধু জাহাঙ্গীর আলম নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আরো একজন শিক্ষকের সাক্ষাৎ হয়। তার নাম মো: সাজেদুল করিম নাসিম। তিনি ২০০২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স পাস করেন। মাস্টার্সে তিনি ৫৮ শতাংশ নম্বর পান। তিনি আলহাজ শামসুর রহমান মডেল কলেজ ফরিদপুর পাবনায় শিক্ষকতা করেন। নাসিম বলেন, জীবনের শুরুতে শিক্ষকতার ইচ্ছা না থাকলেও ভাগ্যের কারণে আজ এ পেশায় রয়েছি। ২০০৯ সাল থেকে তিনি এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। এসএসসি ও এইচএসিতে প্রথম বিভাগ লাভ করা সাজেদুল করিম নাসিম বলেন, অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে তিনিও শুরু থেকে প্রেস কাবের সামনে রাত কাটাচ্ছেন। তাদের কলেজটি উপজেলার মধ্যে সেরা কলেজ। এবারো যদি এমপিওর দাবি পূরণ না হয় তবে তিনি হয়তো আর এ চাকরি চালিয়ে যেতে পারবেন না। এরপর কী করবেন তাও জানা নেই সাজেদুল করিম নাসিমের। 
আন্দোলনরত শিক্ষকেরা জানালেন এখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একজন শিক্ষকও রয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নাম করা অনেক কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স পাস করা শিক্ষক। 
বউ বলেছে বাসায় আসার দরকার নেই : বিমল কুমার বর্মণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেছেন। মাটিনদর বিএম কলেজ নওগাঁ অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন আট বছর ধরে বেতন ছাড়া। বর্তমানে তার বয়স ৫৫। ২০১০ সালে নিবন্ধন পরীক্ষায়ও পাস করেছেন। দু’বার সরকারি প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভাইভায় বাদ পড়েন। কথা বলার একপর্যায়ে ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে বুক দেখিয়ে বিমল কুমার বলেন, সরকার আমাদের গুলি করুক। মরতে রাজি আছি। আমাদের জীবনের আর কোনো দাম নেই। পরিবার, সমাজ, আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। নিজের ছেলেমেয়ের কাছেও কোনো দাম নেই। কুত্তা-বিড়ালের জীবন আমাদের। আন্দোলনে যোগ দিতে ঢাকায় আসার পর বউ ফোন করে বলেছে, তোমার আর বাড়ি আসার দরকার নেই। এমপিও নিয়ে আসিও। 
আমি হেড এক্সামিনার হয়েছিলাম : ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত মোক্ষপুর কলেজের প্রভাষক লোকমান হোসেন আনন্দমোহন কলেজ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস। ২০০৫ সালের প্রথম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নিয়মানুযায়ী অন্য কলেজের খালি পদে তার চাকরি হওয়ার কথা থাকলেও ঘুষ দিতে না পারায় কোথাও তার চাকরি হয়নি। তাই ২০০৪ সাল থেকে বিনা বেতনে চাকরি করছেন এ কলেজে। তিনি নিয়মিত বোর্ডের খাতা দেখেন। মোবাইলের মেসেজ থেকে দেখালেন তাকে এ বছর ঢাকা বোর্ডের একজন হেড এক্সামিনার নিয়োগ করা হয়েছিল কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। লোকমান হোসেন বলেন, বেতন ছাড়া চাকরি জীবন খুবই দুঃখের জীবন ভাই। ছেলেমেয়ের কথা জানতে চাইলে লোকমান হোসেন বলেন, টাকার অভাবে সময়মতো বিয়েও করতে পারিনি। বয়স অনেক হয়ে গেলেও আমার দুই ছেলেমেয়ে অনেক ছোট। 
ঘুষ দিয়ে চাকরি নেবো না : বগুড়া সদরে অবস্থিত তেলিহারা মহিউদ্দিন আলম আলিম মাদরাসার লেকচারার ওয়াজেদ মিয়া জানান, ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল কলেজের লেকচারার হবো। তাই বিনা বেতনে পড়ে আছি এক দিন এমপিও হবে এই আশায়। মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী পাওয়া ওয়াজেদ মিয়া বলেন, আমি ৭ম নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। কিন্তু কোনো কলেজে চাকরি পায়নি। বেশ কয়েকটি কলেজে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ চায়। ঘুষ দিয়ে চাকরি করব না। আর ঘুষ দেয়ার টাকাও নেই। 
অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অনেক স্কুল-কলেজে পরীক্ষাও দিয়েছেন কিন্তু তার পরও তাদের চাকরি হয়নি ঘুষ দিতে না পারায়। বেতন না হওয়ার পরও কেন ১৫-২০ বছর ধরে এই পেশায় পড়ে আছেন জানতে চাইলে অনেক শিক্ষক জানান, আমরাই স্কুল-কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন এটি ছেড়ে কোথায় যাবো? অনেক শিক্ষক জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান নন-এমপিও হওয়ায় সাধারণত শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে চায় না। তাই বিনা বেতনের আশ্বাস দিয়ে তাদের ভর্তি করাতে হয়। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তারা কোনো বেতন পান না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সামান্য বেতন নেয়া হলেও তা দিয়ে প্রশাসন চালানোর খরচও পোষায় না। বিনা বেতনে চাকরি করা শিক্ষকেরা জানালেন, কেউ প্রাইভেট পড়ান, কেউ কৃষিকাজ করেন আবার কেউ বা ছোটখাটো ব্যবসা পরিচালনা করেন শিক্ষকতার পাশাপাশি জীবনধারণের জন্য। 
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে অবস্থিত পাথরডুবি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক আলতাফ হোসেন বলেন, তিনি ১৭ বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরি করছেন। কারমাইকেল কলেজ থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস আলতাফ হোসেন বলেন, আমরা নিজেরাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন এটি ছেড়ে কোথায় যাবো। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর আশকোনানগর এ এস নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শামসুল হক কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় এমএ পাস করে ২০০৩ সাল থেকে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন। বগুড়ার শাহজাহানপুরে অবস্থিত হজরত ইমাম হোসাইন টেকনিক্যাল হাইস্কুলের শিক্ষক আবু ইউসুফ কামেল পাসের সাথে সাধারণ শিক্ষায়ও এমএ পাস করেছেন আজিজুল হক কলেজ থেকে। তিনি বলেন, বাবা বড় আশা নিয়ে আমাদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন বড় কিছু হবো এ কামনায়। আমাদের অনেক ছাত্র অনেক বড় বড় পদে চাকরি করে। আমরা তাদের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। খুলনা পাইকগাছার আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের হরেন্দ্রনাথ রায় জানান, তিনি ২৬ বছর ধরে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করছেন। 
পটুয়াখালীর দশমিনায় অবস্থিত আলীপুরা কলেজের শিক্ষক গোপাল কুমার দাশ বলেন, শিক্ষকেরা রাস্তায় ঘুমান। এ কেমন উন্নয়ন। অনেক উন্নয়নের কথা শুনছি, হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের কথা শুনি কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিও করলে বছরে মাত্র কয়েক শ’ কোটি টাকা প্রয়োজন হতো। শিক্ষার উন্নয়ন প্রকৃত উন্নয়ন হলেও শিক্ষকদের বেতনের অভাবে রাস্তায় ঘুমাতে হচ্ছে। 
বরগুনার বেতাগী থানার রানীপুর নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হাবিবুর রহমান, গনির হাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামান দুলাল, পীরগঞ্জ ঠাকুরগাঁওয়ের খামার সেনুয়া নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আনোয়ার হোসেন, বরগুনার আমতলী থানার টিয়াখালি কলেজের মো: রফিক, সিরাজগঞ্জ উল্লাহপাড়ার বড়হর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শেখ শহীদুল ইসলাম জানান, নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ঘুষ না দেয়ায় তাদের চাকরি হয়নি। 
শিক্ষকেরা জানান, ২০০৫ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওকরণ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সারা দেশের সংসদ সদস্যদের দাবিতে ২০১০ সালে এমপিওকরণের জন্য তালিকা সংগ্রহ করা হয়। প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরখাস্ত জমা হলেও এক হাজার ৬১০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে এমপিওভুক্ত করা হবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। কিন্তু ২০১০ সালের পর আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়নি। বর্তমানে সরকারি সংস্থারই জরিপ অনুযায়ী পাঁচ হাজার ২৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের উপযুক্ত বলে জানান শিক্ষকেরা। এতে ৮০ হাজারের অধিক শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরিরত এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার দাবিতে পাঁচ দিন ধরে রাজধানীর জাতীয় প্রেস কাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকেরা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/280567