২৯ ডিসেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৯:১২

নকল পানিতে আসল ভয়!

রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে সাম্পান রেস্তোরাঁর পার্কিংয়ের পাশেই জমজমাট চায়ের দোকান। মানুষ ভিড় করে খাচ্ছে চা-বিস্কুট, রুটি-কলা।
আর পানি পান করছে পাশে রাখা বড় প্লাস্টিক জার থেকে নিয়ে। পাশেই রাখা আছে পানিভর্তি আরো কয়েকটি জার। ময়লার আস্তরে পাল্টে গেছে বোতলের আসল রং। তবে কোনো কম্পানির নাম-চিহ্নহীন জারগুলোর মুখ ঠিকই নীল রঙের ছিপিতে আটকানো।

এই পানি কি বিশুদ্ধ? খাওয়া যাবে? প্রশ্ন শুনে দোকানি খানিকটা বিরক্তির সুরেই বলেন, ‘আপনার ইচ্ছা অইলে খাবেন, নাইলে খাবেন না। সবাই তো খাইতাছে, এত কথার দরকার কী!’ দরকার কেন তা বুঝিয়ে বলে এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিতেই চেহারা পাল্টে যায় দোকানির। বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘পেটে লাথি মাইরেন না। আমার নামডাও দিয়েন না। মিথ্যা কমু না, এই পানি আসলে ফিল্টারের না।
ওই যে দেখছেন ওয়াসার পাম্প, ওইখান দিয়া ভইর্যার আনছি। সবাই তো নেয়। মানুষের বাসায় সাপ্লাই পানিও তো যায় এই পাম্প দিয়া। তাইলে এই পানি কি খারাপ?’
কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ে ওয়াসার একটি পানির পাম্প। উন্মুক্ত ওই পাম্প থেকে আরো একাধিক ব্যক্তিকে একই ধরনের প্লাস্টিক জারে পানি ভরে নিতে দেখা গেল। পাম্পের কক্ষের দরজা খোলা। বুধবার দুপুর ২টায় সেখানে দায়িত্বরত কাউকেই পাওয়া যায়নি।

অল্প দূরে লালমাটিয়া সি-ব্লকের ফুটপাতে চা-বিস্কুট ও পান-সিগারেটের পসরা সাজিয়ে বসেছেন এক নারী। সেখানেও যথারীতি ভোক্তার ভিড়। পাশে রাখা একই রকম পানির জার। মানুষ তা-ই পান করছে।
কোথা থেকে এনেছেন পানি? প্রশ্নের উত্তরে ওই নারীর সরল স্বীকারোক্তি, ‘সামনের বাসার পানির লাইনের তন আনছি, কিনতে বেশি ট্যাকা লাগে। ’ খামারবাড়ি মোড়ে পুলিশ বক্সের অল্প দূরেই ফুটপাতে রাখা অনেক প্লাস্টিক কনটেইনার। কোনোটি ভরা, কোনোটি খালি। পাশের গলিতে থাকা এক চা বিক্রেতা জানালেন, পানি তাঁদের জন্যই রাখা হয়েছে। এগুলো ফিল্টার করা পানি কি না জানতে চাইলে বললেন, ‘আমরা তো ফিল্টার পানিই কিনি। আসলে কতটা ফিল্টার, সেইটা জানি না। ’
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই পথেঘাটে ও হাটবাজারে পায়ে পায়ে চোখে পড়ে এমন ‘ফিল্টার পানি’র বোতল বা কনটেইনার। ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রেস্তরাঁ, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমনকি বাসাবাড়িতেও চলছে এসবের ব্যবহার। কিন্তু এই ‘ফিল্টার পানি’ আসলেই কতটা নিরাপদ, সে খোঁজ জানা নেই বেশির ভাগ মানুষের। খোদ সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের কাছেও নেই এর জবাব। তবে আরেক প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণায় উঠেছে বিপজ্জনক চিত্র।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার জারের পানিতে মারাত্মক দূষণ রয়েছে। এসব পানি থেকে কলেরা-ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগ ছড়াচ্ছে।
ওই গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেওয়া বার্কের পরিচালক (পুষ্টি) ড. মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকায় ঠিক কী পরিমাণ জারের পানি ব্যবহার করা হয় তার সঠিক হিসাব করা যায়নি। এমনকি কতটি কম্পানি এই জারের পানি উৎপাদন ও বিক্রি করে, সেটাও নিশ্চিত নই। তবে ধারণা পাওয়া গেছে যে সংখ্যাটি পাঁচ শতাধিক হবে। কিন্তু এর মধ্যে সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত আছে মাত্র ৩০০টি। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ঢাকার ২৪টি পয়েন্টের ২৫০টি জারের পানির নমুনা সংগ্রহ করে তা ল্যাবে পরীক্ষা করেছি। এতে দেখা গেছে, টোটাল কলিফর্ম প্রতি ১০০ মিলিলিটারে সর্বনিম্ন ১৭ ও সর্বোচ্চ এক হাজার ৬০০ মোস্ট প্রব্যাবল নম্বর (এমপিএন) এবং ফেকাল কলিফর্ম প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ১১ ও সর্বোচ্চ ২৪০ এমপিএন। অথচ এর সহনীয় মানমাত্রা ‘০’ (শূন্য) থাকার কথা (কলিফর্মের মাত্রা প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ২-এর নিচে থাকলেও তাকে শূন্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়)। ’

কর্মকর্তাটি জানান, এই গবেষণার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া, সাভার, চকবাজার, সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে।
বিএসটিআইয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময় অভিযানে অবৈধ অনেক পানির ফিলিং মেশিনের আল্ট্রাভায়োলেট রে পাওয়া যায়নি। ফলে এসব মেশিনে শুধু ফিল্টার বা ছাঁকনি ব্যবহার করে ময়লা দূর করা গেলেও সব জীবাণু বা ভাইরাসমুক্ত করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আল্ট্রাভায়োলেট রের জন্য বিশেষ মেশিন দরকার। ওই মেশিনের দাম বেশি বলে অনেকেই তা ব্যবহার করে না। এ ছাড়া অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত কোনো ল্যাব কিংবা কেমিস্টও থাকে না।
সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে কিছুদিন আগেই পথখাবারের ওপর সমীক্ষা চালানো হলেও পানি নিয়ে আলাদা কোনো সমীক্ষা করেনি তারা। তবে পথখাবারের ওই সমীক্ষার প্রতিবেদনের তথ্য, এসব খাবারে যেসব জীবাণু পাওয়া গেছে তা বেশির ভাগই পানিবাহিত।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট করে বাণিজ্যিক ফিল্টার্ড পানির পরীক্ষা এখনো আমরা সরাসরি করি না। তাই এসব পানি ঠিক কতটা নিরাপদ তা বলা সম্ভব নয়। যদিও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের ল্যাব থেকে নিজ নিজ উদ্যোগে পানি পরীক্ষা করিয়ে নেয়। এখন ভাবছি, বিষয়টি নিয়ে কাজ করা দরকার। আমরা শিগগিরই পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নেব। ’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু এবার নয়, ঢাকায় ২০১৫ সালে এক কর্মসূচির মাধ্যমে দেখেছি, ৫৫ শতাংশ পথখাবারই অনিরাপদ। মূলত দূষিত পানিই এ জন্য বেশি দায়ী। ’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, ‘পানির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি রোগ ছড়ায়। বিশেষ করে রোটা ভাইরাসের ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি। শীতকালে এই ভাইরাসের ভয়টা আরো বেশি। ডায়রিয়ার ভয় আগের তুলনায় কমলেও ডায়রিয়ার জন্য অধিক বিপজ্জনক রোটা ভাইরাসের প্রকোপ কমেনি। বরং আরো ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। ফলে এখনো ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু একেবারে বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দূষিত পানির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নিরাপদ পানি পানের ব্যাপারে ঘরে ঘরে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ’ তিনি বলেন, ‘জারের পানি কতটা নিরাপদ তা নিয়ে আরো জোরালোভাবে কাজ করা দরকার। নবগঠিত ফুড সেফটি অথরিটি এবং বিএসটিআইয়ের এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব অনেক বেশি। ’

আইসিডিডিআর,বি সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির এক সার্ভেইল্যান্সে দেখা গেছে, দেশে ডায়রিয়ার জন্য দায়ী ভি-কলেরি, সিগেলা, ইটিইসি ও রোটা ভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় সংক্রমণ রয়েছে রোটা ভাইরাসের। এর সবটাই দূষিত বা অনিরাপদ পানির কারণে হয়ে থাকে।
যেভাবে চলে নকল পানির ব্যবসা : পানের পানি নিয়ে অসাধু ব্যবসার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে থাকে। হাতেনাতে ধরাও পড়ে। কারখানা বন্ধ করা হয়। সাজা দেওয়া হয় অসাধু ব্যবসায়ীদের। কিন্তু তাতেও অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলা যাবে না।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু এক-দুটি নয়, বেশ কয়েকটি অভিযানের অভিজ্ঞতা হলো—প্রায় ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই তাদের পানি উপযুক্ত মানের ফিল্টারিং করে না। এর মধ্যে অনুমোদিত ও অননুমোদিত দুই ধরনের কম্পানিই রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো—বেশির ভাগ কম্পানিই ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ওপর নির্ভরশীল। এক গ্রুপ আছে যারা সরাসরি আশপাশের সাপ্লাই লাইন থেকে পানি ভরে মুখ বন্ধ করে দোকানে দোকানে দিয়ে আসে। আরেক গ্রুপ হচ্ছে বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নিয়ে প্রথম কিছুদিন মান বজায় রাখলেও পরে বেশি মুনাফার লোভে খরচ কমিয়ে যেনতেনভাবে পানি বাজারজাত করে। এ ছাড়া অনেক কম্পানিই ফুড গ্রেড জার ব্যবহার না করে সাধারণ মানের প্লাস্টিক জার ব্যবহার করে থাকে। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। নমুনা পরীক্ষায় এসব জারের পানিতে ই-কোলাইয়ের মতো মারাত্মক জীবাণু পাওয়া গেছে। অভিযানকালে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ও নোংরা পানি পরিশোধন না করেই বাজারজাত করার নমুনাও পেয়েছি। অনেক জারে শেওলার স্তর পড়ে তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ’

র্যা ব সূত্র জানায়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে কিছুদিন আগে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ফিল্টারবিহীন ও জীবাণুযুক্ত পানির বোতল এবং জার বাজারজাত করার অপরাধে ঢাকার চার প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। রাজধানীর গোপীবাগ, যাত্রাবাড়ী, গেণ্ডারিয়া ও সূত্রাপুর এলাকায় ওই অভিযান চালানো হয়। এ সময় সিলগালা করা হয় গোপীবাগের আর কে মিশন রোডের ভাইটাল ড্রিংকিং ওয়াটার, যাত্রাবাড়ীর পশ্চিম গোপালবাগের সাবরিনা ড্রিংকিং ওয়াটার, গেণ্ডারিয়ার বেগমগঞ্জ লেনের আপলাইন ফ্রেশ ওয়াটার ও সূত্রাপুরের স্বামীবাগের বিক্রমপুর প্রোডাক্টস নামের কম্পানি। একই সময় প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক-কর্মচারীদের জেল-জরিমানা করা হয়।

জারের পানি ব্যবসায় জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, রাজধানীর অনেক এলাকায় স্থানীয় কিছু লোকজন জারপ্রতি বখড়া আদায় করে সরবরাহ লাইনের দূষিত পানি বাজারজাতকরণে তাদের সহায়তা করে থাকে।
লাইনে দূষিত পানি সরবরাহ করা প্রসঙ্গে একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে ওয়াসার পানি সঠিক মাত্রায় নিরাপদ করা যাচ্ছে না মারাত্মকভাবে নদী দূষণের ফলে। এ ছাড়া পরিশোধনের মাধ্যমে পানি শতভাগ সুপেয় করে সরবরাহ করলেও পানির পাইপ ও ট্যাংক পরিষ্কার বা জীবাণুমুক্ত না থাকায় ওই পানিতে দূষণ ঘটে থাকে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/12/29/583162