২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৭

এমপিওভুক্তি বন্ধ ১৮ বছর

ভুগছেন ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী

২০১০ সাল থেকে প্রায় ১৮ বছর স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ যেকোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি বন্ধ রয়েছে। অথচ নতুন নতুন নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।

ফলে সেসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের নিয়ে জটিলতা বাড়ছে।
আবার প্রতিষ্ঠান বেশি হয়ে যাওয়ায় যেসব স্কুল-কলেজ অপরিহার্য সেগুলোর এমপিওভুক্তি হচ্ছে না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা দীর্ঘদিন বিনা বেতনে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আট মাইলের মধ্যে কোনো অনুমতি বা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কলেজ থাকলে নতুন কোনো কলেজ খোলা যাবে না। আর তিন মাইলের মধ্যে মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলে নতুন করে খোলা যাবে না। ইবতেদায়ি মাদরাসার ক্ষেত্রে এই দূরত্ব এক মাইল, জুনিয়র মাদরাসা ও দাখিল মাদরাসার ক্ষেত্রে চার মাইল, আলিম মাদরাসার ক্ষেত্রে আট মাইল, ফাজিল মাদরাসার ক্ষেত্রে ১০ মাইল দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং প্রতি জেলায় একটিমাত্র কামিল মাদরাসা স্থাপন করা যাবে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাওয়ায় নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা করা হয় না। এভাবে দিন দিন অপ্রয়োজনীয় স্কুল-কলেজের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এতে খুবই প্রয়োজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও এমপিওবঞ্চিত হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল ও মাদরাসার আসনসংখ্যার প্রকৃত কোনো হিসাব নেই। তবে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশ নেয় প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী। আসনসংখ্যা এর দ্বিগুণ বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
কিন্তু মানসম্পন্ন স্কুলের সংখ্যা না বাড়ায় ঘুরেফিরে কিছু স্কুলেই ঝুঁকছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ২১ লাখ আসন থাকলেও ভর্তি হয় মাত্র ১৩ লাখ। এতেই বোঝা যায় অপ্রয়োজনীয় স্কুল-কলেজের সংখ্যা। কিন্তু এর পরও নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত হচ্ছে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে জটিলতা বাড়ছে।

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের ব্যানারে গত মঙ্গলবার থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষকরা। তাঁরা এমপিওভুক্তির দাবিতে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে সরকার স্বীকৃত নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সংখ্যা পাঁচ হাজার ২৪২। এতে ৮০ হাজারের মতো শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি করছেন, যাঁদের বেশির ভাগই বিনা বেতনে।
নওগাঁ জেলার পৌরশা উপজেলার শরিয়ালা পূর্বপাড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আফজাল হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান ১৯৯৭ সালে স্থাপিত। আমাদের আশপাশের সাত-আট উপজেলার মধ্যে কোনো স্কুল নেই। আমি ২০০০ সাল থেকে বিনা বেতনে চাকরি করছি। আর পারছি না। ’
আফজাল হোসেন আরো বলেন, ‘পরিবার নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছি। পরিবার থেকে বলছে চাকরি ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে কোনো কিছু করতে। কিন্তু শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় ১৭ বছর রয়েছি, এখানেই বাকি জীবনটা থেকে যেতে চাই। ’

এ ছাড়া ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার বহরমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ওহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্কুল নেই। এ অবস্থায় ১৯৯৪ সালে আমাদের স্কুল স্থাপিত হয়। আমি ২০০৪ সাল থেকে চাকরি করছি। অথচ বেতন পাই না। একটি মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। জমি চাষ করে কোনো রকমে জীবন চালিয়ে নিচ্ছি। তাই বাড়ি থেকে বলে এসেছি, দাবি আদায় না করে বাড়ি ফিরব না। ’
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ছোট গাবুয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার শিক্ষক মো. খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২০০১ সাল থেকে আমাদের মাদরাসার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমি চাকরি করছি। আমাদের মাদরাসার চার কিলোমিটার দূরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিনা বেতনে ১৬ বছর ধরে চাকরি করছি। ৩০০ জন শিক্ষার্থী। তাদের পেছনে সারা দিন পড়ে থাকলেও মাস শেষে শূন্যহাতে ফিরতে হয়। মানবেতর জীবন যাপন করছি। ’
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মতো নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান একই নিয়মে পরিচালিত হয়। একই কারিকুলাম, সিলেবাস আমরা অনুসরণ করি। আমাদের শিক্ষার্থীরা বোর্ড থেকে একই মানের সার্টিফিকেট পায়। অথচ আমরা বেতন পাই না। তাহলে কেন আমাদের স্বীকৃতি দেওয়া হলো?’
গোলাম মাহমুদুন্নবী বলেন, ‘আমদের প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম মেনেই প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে। এরপর স্বীকৃতি পেয়েছে। তাহলে যদি আমাদের প্রয়োজনীয়তা না থাকত তাহলে কেন স্বীকৃতি নবায়ন করা হয়? আমাদের নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে ২০ লাখ শিক্ষার্থী পড়ছে। তারা ভালো ফল করছে। তাহলে কেন আমাদের এমপিও দেওয়া হবে না?’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আগে নিয়মিতভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হতো। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে তা বন্ধ রয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে জাতীয় সংসদে এমপিরা একাধিকবার দাবি তুলেছেন। সম্প্রতি এমপিওভুক্তির ব্যাপারে অর্থ প্রতিমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটিও করা হয়েছে। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সম্ভাবনা থেকেই শিক্ষকরা আন্দোলন নেমেছেন। কিন্তু গত দুই দিনের আন্দোলনে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষকরা কোনো আশ্বাস পাননি বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয়টি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের। এর পরও শিক্ষকরা কোনো দাবি জানালে আমরা উচ্চ মহলকে জানাব। ’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/12/28/582783