১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২২

আদায় অযোগ্য ঋণ সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

বেসিক ব্যাংকের আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ দেখানো হয়েছে সাত হাজার ৫৫১ কোটি টাকা, যা বেসিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৯৪ শতাংশ। বেসিক ব্যাংক এই ঋণকে কিছুটা ভালো ভাষায় ‘মন্দ ও ক্ষতিজনক’ হিসেবে বর্ণনা করলেও এত বিশাল পরিমাণ ঋণ আদৌ আর কখনো আংশিক বা কিছুটা আদায় করা যাবে কি না তা নিয়ে স্বয়ং ব্যাংক কর্মকর্তারাই সন্দেহের মধ্যে রয়েছেন। কারণ ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এই ঋণগুলো কোনো রকম নিয়মনীতি না মেনে প্রদান করেছেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন পরিচালনা পর্ষদ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে এই ঋণগুলো দেয়া হয়েছিল, তার অনেকগুলোর এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হবে, ‘মন্দ ও ক্ষতিজনক’ ঋণ আর আদায় করা যাবে না।

বেসিক ব্যাংকের বর্তমান হালহকিকত কী তা জানতে চেয়েছিল জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাবসম্পর্কিত ৩ নম্বর সাবকমিটি। কমিটির জন্য এই তথ্য সরবরাহ করেছে বেসিক ব্যাংক। কমিটির বৈঠকটি আজ জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। শুধু বেসিক ব্যাংক নিয়েই আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। এখান থেকে আসতে পারে ব্যাংকটি সম্পর্কে কিছু দিক নির্দেশনা।

শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক এক সময় লাভজনক ছিল। ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৬৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সেই ব্যাংকটিই মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে নিট লোকসান করে বসে ১১০ কোটি টাকা। এর কারণ হিসেবে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেই সময়ের ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ‘সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি’কে চিহ্নিত করেছে। বেসিক ব্যাংক বলছে, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড ১৯৮৯ সালের ২১ জানুয়ারি তার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। সূচনালগ্ন থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আর্থিক সূচকের ক্রমোন্নতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকিং সেক্টরে একটি স্বচ্ছ ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। কিন্তু ২০১০-১৪ সময়ে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি ব্যাংকের সার্বিক কর্মকাণ্ডের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে এবং বিভিন্ন সূচকে চরম অবনতি হয়। ফলে ২০০৯ সাল শেষে যেখানে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪১ কোটি ২৩ লাখ টাকা, ২০১৪ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ১০৮ কোটি টাকায়।
২০০৯ সাল শেষে ব্যাংকটিতে কোনো মূলধন ঘাটতি এবং প্রভিশন ঘাটতি না থাকলেও ২০১৪ সালে তা হয় তিন হাজার ৫১৬ কোটি টাকা এবং তিন হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা।

বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিষয়ে বলা হয়েছে, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে অশ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ। একই সময়ে শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৪৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৫৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। শ্রেণিকৃত ঋণের মধ্যে রয়েছে বিরূপমানে শ্রেণিকৃত ২১৬ কোটি টাকা সন্দেহজনক ২৭৮ কোটি টাকা এবং মন্দ ও ক্ষতিজনক ঋণ সাত হাজার ৫৫১ কোটি টাকা।
তবে বেসিক ব্যাংক বলছে, বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার কারণে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ কমে আসছে। কারণ ২০১৪ সালে যেখানে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬৮ শতাংশ, এখন তা কমে হয়েছে ৫৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটি লাভজনক ব্যাংক ছিল। কিন্তু এরপর যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু নিয়োগ দেয়া হয় তখন থেকেই ব্যাংকটির আর্থিক অনিয়মের সূত্রপাত ঘটে। চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যক্ষ মদদে বেসিক ব্যাংকে একে একে ঘটে যায় অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ করা হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা, যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সেই ঋণ অনুমোদন করেছে। ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় না। পর্ষদের ১১টি সভায় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যার অধিকাংশ ঋণই গুরুতর অনিয়মের মাধ্যমে করা হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ বা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেও মত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/277699