১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৬

সু চির সম্মতিতেই রোহিঙ্গা নির্যাতন হয়েছে : জাতিসঙ্ঘ

মিয়ানমারে মুসলমান সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অনুমোদন সে দেশের নেত্রী অং সান সু চির অনুমোদনেই হয়েছে বলে ধারণা করছেন জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রাদ আল হুসাইন। এ জন্য মিয়ানমারের নেতাদের একসময় বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বলে তিনি জানান।
বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার বিষয়গুলো দেখভাল করে জাতিসঙ্ঘের এই প্রতিষ্ঠানটি, যার প্রধান হুসাইন।
রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ গণহত্যা চালানোর সাথে জড়িত হোতারা বিচারের মুখোমুখি হবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদের প্রধান জাইদ রা’দ আল হুসাইন। মিয়ানমারের বেসামরিক নেতা অং সান সু চি ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল অং মিন হ্লেইংও হয়তো ভবিষ্যতে কোনো সময়ে নিজেদের গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্তদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন। এমন সম্ভাবনার জোরালো আভাস দিয়েছেন রা’দ।
চলতি মাসের শুরুতে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক পরিষদে জাইদ রা’দ আল হুসাইন বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক এবং পরিকল্পিত নিপীড়নের ধরন দেখে এটিকে গণহত্যা না বলে পারা যায় না। জেনেভায় জাতিসঙ্ঘের প্রধান কার্যালয়ে তিনি বলেন, সামরিক অভিযানের পরিসরে এটি পরিষ্কার যে, উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

গণহত্যা এমন একটি শব্দ যে সম্পর্কে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়। এটি ভয়াবহ ‘অপরাধের চেয়েও বড় অপরাধ’। খুব কম মানুষই এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। হলোকাস্টের পর এই অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনেকেই একটি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেন। এতে বলা হয়, গণহত্যা হচ্ছেÑ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্যে সংঘটিত অপরাধ।
তবে তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘ভয়াবহ নিষ্ঠুর হামলায়’ দায়ী হোতাদের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। এই কাজ যে অত্যন্ত কঠিন হবে সেটিও স্বীকার করেছেন তিনি। ‘মূল কারণ হলো, আপনি যখন গণহত্যা সংঘটনের পরিকল্পনা করবেন; তখন আপনি এটি কাগজে-কলমে করবেন না এবং আপনি দিকনির্দেশনাও দেবেন না।’
তিনি বলেন, ‘বিচার শুরুর জন্য যথেষ্ট প্রমাণ আছে। তবে আমরা যা দেখেছি তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে কোনো একটি আদালত যদি গণহত্যার অভিযোগ গঠন করে, তাহলে এতে আমি আশ্চর্যান্বিত হবো না।’ জাইদ রা’দ আল হুসাইন টেলিফোনে সু চির সাথে গত ফেব্রুয়ারিতে কথা বলেন। এই সময় তার (রা’দ) কার্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি নথিতে গত বছরের অক্টোবরের শুরু থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর রাখাইনে নৃশংস অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে বলে তুলে ধরা হয়।

জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই সামরিক অভিযান বন্ধ করতে আমি তাকে আহ্বান জানিয়েছিলাম। মানবিক জায়গা থেকে অভিযান বন্ধ করতে কিছু একটা করার জন্য আমি তাকে আহ্বান জানিয়েছিলাম...এটি আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের যে তিনি কোনো পদক্ষেপই নেননি।’ সেনাবাহিনীর ওপর সু চির ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। তবে জাইদ রা’দ আল হুসাইনের বিশ্বাস, তিনি চেষ্টা করলে কিছু করতে পারতেন এবং সেনা অভিযান থামাতে পারতেন। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি সু চির সমালোচনা করেন। ‘তাদের নাম ধরে না ডাকাটা অমানবিক কাজ; যেখানে আপনি বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছিলেন যেকোনো কিছুই সম্ভব।’
মিয়ানমার সরকার বলছে, গত ২৫ আগস্ট সন্ত্রাসী হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য নিহতের জবাব দিতে তারা সামরিক অভিযান শুরু করেছে। বিবিসির প্যানোরোমা অনুষ্ঠানের কর্মীরা প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান এ অভিযানের প্রস্তুতি তারও অনেক আগে থেকে নেয়া শুরু হয়েছিল।
বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘যে মাত্রায় এবং যেভাবে সেখানে সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে, তা অবশ্যই দেশের উঁচুপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ওই অভিযানে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে এবং লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।’
হুসাইন বলছেন, ‘এ জন্য মিয়ানমারের নেতাদের একসময়ে গণহত্যার অভিযোগের মুখোমুখি হতে হবে।’
যদিও এসব অভিযোগের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি অং সান সু চি, যিনি একসময় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রা’দ আল হুসাইন বলেছেন, যে মাত্রায় এবং যেভাবে সেখানে সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে, তা অবশ্যই দেশের উঁচুপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিবিসির সংবাদদাতা জাস্টিন রোল্যাট বলছেন, ‘মিয়ানমারের নেতাদের ভবিষ্যতে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে, জাতিসঙ্ঘের এই নজরদারি প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের এই বক্তব্য খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।’
এ মাসের শুরুর দিকেই জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দেয়া বক্তব্যে হুসাইন বলেছিলেন, মিয়ানমারে যে ব্যাপক বা পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, তাতে গণহত্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের পর জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলো একটি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে কোনো গোত্রকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টাকে গণহত্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু তার এই বক্তব্যের পর কি অং সান সু চির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হতে পারে?
জাস্টিন রোল্যাট বলছেন, মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছে কি না, সেটি প্রমাণের দায়িত্ব জাইদ রা’দ আল হুসাইনের নয়। কিন্তু তিনি হয়তো আন্তর্জাতিক একটি তদন্ত চাইতে পারেন।
যদিও হাইকমিশনার বলছেন, সেটিও কঠিন একটি কাজ। তিনি বলছেন, ‘কেউ যদি গণহত্যা চালানোর পরিকল্পনা করে, সেটি তো তারা কাগজ-কলমে করবে না। হয়তো আপনি কোনো নির্দেশনার প্রমাণও পাবেন না। তবে এখন আমরা যা দেখছি, তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে কোনো আদালত যদি এরকম কোনো তদন্তের আদেশ দেয়, তাতে আমি অবাক হবো না।’

আগস্টে এই অভিযান শুরুর পর সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। শত শত গ্রাম পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সেখানে ব্যাপক হত্যা আর গণধর্ষণের বর্ণনা দিয়েছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা।
স্যাটেলাইটে তোলা ছবি বিশ্লেষণের পর যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, বার্মার (মিয়ানমার) রাখাইন রাজ্যে গত দুই মাসে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আরো ৪০টি গ্রামের ভবনসহ বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে বলে সংস্থাটি দেখতে পেয়েছে। ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে এ নিয়ে ৩৫৪টি গ্রাম আংশিক বা পুরোপুরি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/277686