১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৪

ইসরাইলের নতুন ষড়যন্ত্র ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিকল্পনা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুসালেমকে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করে মার্কিন দূতাবাস সেখানে স্থানান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করায় মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া একটি বিরাট ধাক্কা খেল বলে মনে হয়। কেউ কেউ বলছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘোষণা দ্বারা সারা বিশ্বের ১৮০ কোটি মুসলমানের অন্তরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। সারা দুনিয়ায় এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল মুসলমানদের পবিত্র ভূমি জেরুসালেমে বৃটেন-আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো কর্তৃক সৃষ্ট একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রটিকে তারাই অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পরমাণু শক্তিধর একটি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে এবং তাদের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে এই রাষ্ট্রটি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সারা মুসলিম দুনিয়ার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।

পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে গত ২রা নভেম্বর বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশসমূহে বালফোর ঘোষণা দিবস পালিত হয়েছে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯১৭ সালের এই দিনে যুদ্ধকালীন বৃটিশ মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর বৃটিশ রাজের পক্ষ থেকে তৎকালীন জায়নিস্ট লীগের অন্যতম নেতা লর্ড রথচাইল্ডকে উদ্দেশ করে একটি আশ্বাস পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে রাজকীয় যুক্তরাজ্য সরকারের মন্ত্রী সভার সিদ্ধান্তকে সংক্ষেপিত করে নিম্নোক্তভাবে উপস্থাপন করা হয় :
“His Majesty’s government view with favour the establishment in Palestine of a national home for the Jewish people, and will use their best endeavours to facilitate the achievement of this object, it being clearly understood that nothing should be done which may prejudice the civil and religious rights of existing non-Jewish communities in Palestine, or the rights and political status enjoyed by Jews in any other country.”
অর্থাৎ মহামান্য রাজকীয় সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সহানুভূতির সাথে মেনে নিয়েছেন। তারা এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন। এটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে যে এ দ্বারা এমন কিছু করা হবে না যাতে ফিলিস্তিনের বিদ্যমান অইহুদী সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার ক্ষুণœ হয় অথবা অন্যান্য দেশের ইহুদীরা বর্তমানে যে সুযোগ সুবিধা অধিকার ভোগ করছে তার উপর কোনও বিরূপ প্রভাব পড়ে।

এই ঘোষণাপত্রের কথাগুলো অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এতে ইহুদীদের জন্য আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার যেমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তেমনি ইহুদী নয় এমন সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষারও কথা বলা হয়েছে। তবে অত্যন্ত চালাকির সাথে এতে ‘মুসলিম’ শব্দটি এড়িয়ে গিয়ে অইহুদী বা ইহুদী বহির্ভুত সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে। বৃটেনের এই প্রতিশ্রুতিটি ১৯৪৮ সালে বাস্তবায়িত হয়। তবে দুর্ভাগ্যবশত মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা সংক্রান্ত তাদের প্রতিশ্রুতিটি বাস্তবে বিপর্যয়ে রূপান্তরিত হয়।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, ১৯২২ সালে বর্তমান জাতিসংঘের পূর্বসুরী লীগ অব নেশনস যুক্তরাজ্যকে ফিলিস্তিনের জন্য একটি ম্যান্ডেট প্রদান করে এবং এর মাধ্যমে ভূমি মালিক ও বসবাসকারীদের অনুমতি ছাড়াই বৃটেনকে এই পবিত্র ভূমির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইহুদীদের আগমণকে সীমিত করার চেষ্টা করলে জায়নবাদী সন্ত্রাসীরা তাদের আক্রমণ করে। বিখ্যাত কিংডেভিড হোটেলের বোমা বর্ষণে প্রায় ১০০ লোক মারা যায় এবং বৃটেন বুঝতে পারে যে তারা একটি গভীর গর্তে গিয়ে পড়েছে। প্রতিক্রিয়াতে তারা শুধু এটি থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে।

১৯৪৮ সালে জাতি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় প্রায় ১০ লক্ষ ফিলিস্তিনী মুসলমানকে তাদের পৈত্রিক ভূমি থেকে উৎখাত করে ইহুদীরা তাদের জমি নিয়ে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরাইলে ইউরোপীয় ইহুদীদের ব্যাপক অভিবাসন ঘটতে থাকে। এর ফলে জনসংখ্যাতাত্বিক যে পরিবর্তন ঘটে তাতে ফিলিস্তিনের উপর চাপিয়ে দেয়া ইসরাইল অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূখন্ডে পরিণত হয়। তখন জাতিসংঘ চুক্তির আওতায় পূর্ব জেরুসালেম (জর্দান অংশ) এবং ইসরাইল (পশ্চিম জেরুসালেম) উভয় দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল পূর্ব জেরুসালেম আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। এতে আল আকসা কমপ্লেক্সটি বোমায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তখন থেকে সমগ্র জেরুসালেম ইসরাইল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
মুসলিম জাতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এই জেরুসালেম। মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস এখানেই। বাইতুল মোকাদ্দাস আমাদের প্রথম কেবলা। এই পবিত্র স্থানটি অসংখ্য নবী-রাসুল (সা.)দের ইবাদত এবং প্রচার কেন্দ্র ছিল। এখানে অনেক নবী-রাসূল (সা.) এবং আওলিয়াদের কবরও রয়েছে। এখান থেকেই শেষ নবী রাসুল মোহাম্মদ (সা.) পবিত্র মেরাজের রাতে ঊর্ধ্বাকাশ সফর শুরু করেছিলেন। জেরুসালেম শহরকে আল্লাহ পবিত্র ও বরকতময় ঘোষণা করেছেন। সুরা বনি ইসরাইলের ১নং আয়াতে বলা হয়েছে, “পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তার বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য।”
খানায়ে কাবা তথা মসজিদুল হারামের মূল প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন হযরত আদম (আ.) এবং মসজিদুল আকসার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)। ৬৩৮ খৃস্টাব্দ থেকে ১০৯৯ সাল পর্যন্ত এই ৫০০ বছর জেরুসালেম মুসলমানদের অধীনে ছিল। ১০৯৯ সালে খৃস্টান ক্রুসেডাররা কিছু গাদ্দারের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয় এবং বাইতুল মোকাদ্দাস অবরোধ করে। এই সময় মসজিদে ঢুকে তারা ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। মসজিদকে তারা গীর্জায় রূপান্তরিত করে এবং গম্বুজের উপর ক্রুশ স্থাপন করে এর নাম রাখে সুলাইমানী প্রার্থনাগার।

খৃস্টানরা ৮৮ বছর পর্যন্ত তা দখলে রাখে এবং ১১৮৭ সালে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে জেরুসালেম শহর মুসলমানদের দখলে নিয়ে আসেন। জেরুসালেম পুনরুদ্ধারের পর তিনি আগের নকশা অনুযায়ী মসজিদের সংস্কার করেন। বর্তমানে মসজিদটি ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের দখলে। ১৯৪৮ সালের আগে দুনিয়াতে ইসরাইল নামের কোনও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৪৮ সালে এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমেরিকা, বৃটেন, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ মোট ৩৩টি দেশ এর স্বীকৃতি দেয়। ’৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূখন্ড ইসরাইল দখল করে নেয়। আরবের মুসলিম দেশগুলো শুধু নয়, সারা দুনিয়ার মুসলমানরা তাদের হাতে পরাজিত হয়। দখলদার ইহুদীদের অত্যাচার নির্যাতনে ৪০ লক্ষ ফিলিস্তিনী মুসলমান ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রতিবেশি মুসলিম দেশগুলোতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পক্ষান্তরে বিভিন্ন দেশ থেকে এসে ১১ লক্ষ ইহুদী ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর দখল করে নেয়। ১৯৬৯ সালে ইহুদীরা আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগও করেছিল। তারা মসজিদ ও গম্বুজ ধ্বংস করে তাদের কথিত প্রার্থনাগার তৃতীয় মন্দির তথা হাইকেলে সুলায়মানী সেখানে প্রতিষ্ঠা করে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প-এর ঘোষণা সারা দুনিয়া, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন একটি অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করার পর্যায়ে নিয়ে আসছে। এর অন্যতম প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে জেরুসালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলিম দেশসমূহের জন্য এটি একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলে আমার ধারণা। তারা যদি এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং ইহুদীদের মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইহুদী সংস্থাগুলোর সাথে সকল বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে তাহলে হয়ত এই প্রতিক্রিয়া কিছুটা সফলতা বয়ে আনতে পারে। তা না হলে শুধু আবেগ দিয়ে সমস্যার সমাধান হতে পারে না। রুখে দাঁড়ানোর জন্য মুসলমানদের এটি হয়ত শেষ সুযোগ। যারা নতুন একটি বিশ্বযুদ্ধ চান না, শান্তি চান তাদের উচিত নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে প্রতিহত করা।

http://www.dailysangram.com/post/311646