১৮ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:৩৪

অনুসন্ধান - ১

জনশক্তি রফতানিতে বিশৃঙ্খলা দালালদের দাপট

গরিবের টাকা মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে

জনশক্তি রফতানি বছর বছর সংখ্যায় বাড়লেও, আসেনি শৃঙ্খলা। চলতি বছরে রেকর্ড সংখ্যক ১০ লাখ কর্মী বিদেশে গেছে। টিআইবির তথ্যানুযায়ী, ৯০ শতাংশ পুরুষ কর্মী দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ৫২ শতাংশেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী দালালের মাধ্যমে বিদেশ যায়। তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত ব্যয়ের তিন থেকে চার গুণ টাকা আদায় করে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, অনিয়মের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। বরং দালাল ধরে কয়েক গুণ ব্যয় করে বিদেশ যাওয়া স্বীকৃত পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে।
এ অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের অজ্ঞতাকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, 'কর্মীরা অভিযোগ করে না, তাই ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।'
গত এক সপ্তাহে শতাধিক বিদেশগামী কর্মীর সঙ্গে কথা বলে মাত্র একজনকে পাওয়া যায়, যে নির্ধারিত ব্যয়ে বিদেশে যাচ্ছে। দালাল তো বটেই, রিক্রুটিং এজেন্সিও মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকায় রয়েছে। কর্মীদের কাছ থেকে ইচ্ছামাফিক টাকা আদায় করছে তারা।

গত বুধবার প্রবাসীকল্যাণ ভবনের ফিঙ্গার প্রিন্ট শাখায় কথা হয় মো. আবদুল্লাহর সঙ্গে। পাসপোর্ট নম্বর বিএম-০০২৮৭৫২। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। কারখানা শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। কোনো প্রশিক্ষণ নেই তার। গত ১৪ জুন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়াগামী কারখানা ও নির্মাণ শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করেছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। বিমান ভাড়া, ভিসা ফি ও প্রসেস, সার্ভিস চার্জ, এজেন্সি ফি- সব খরচসহ এই ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আবদুল্লাহকে দিতে হচ্ছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তিনি যাচ্ছেন ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। এর মালিক এজেন্সিগুলোর সংগঠন 'বায়রা'র মহাসচিব রুহুল আমিন।
কেন দুই লাখ টাকা বাড়তি নেওয়া হচ্ছে, তা জানেন না আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, স্থানীয় এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা চেয়েছে। বলেছে, এর কম হলে মালয়েশিয়া যাওয়া হবে না।
এজেন্সির প্রতিনিধিও জবাব দিলেন না- কেন দুই লাখ টাকা বাড়তি নেওয়া হচ্ছে। যোগাযোগ করে বক্তব্য পাওয়া যায়নি রুহুল আমিনেরও।
তবে বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন এবং সরেজমিন দেখা যায়, বিদেশগামী গরিব কর্মীদের কাছ থেকে বাড়তি আদায় করা টাকা যাচ্ছে দালাল ও এজেন্সির পকেটে।

গত বৃহস্পতিবার প্রবাসীকল্যাণ ভবনে কথা হয় নারায়ণগঞ্জের মো. আমিন ও আবু সিদ্দিকের সঙ্গে। দু'জনেই যাবেন সৌদি আরব। কোন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যাচ্ছেন, তা জানেন না। সেখানে গিয়ে কী কাজ করবেন, তাও জানেন না। আবু সিদ্দিক জানালেন, তার চাচাত ভাই ৪ লাখ টাকায় ভিসা পাঠিয়েছেন। স্থানীয় এক 'ভাইয়ের' মাধ্যমে ভিসা প্রসেসিং করছেন। তাকে দিতে হবে ২ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৬ লাখ! এর বেশি তার জানা নেই।
বয়স কিছুটা বেশি হলেও মো. আমিনেরও একই দশা। জানালেন, তিনিও একই প্রক্রিয়ায় যাচ্ছেন। আত্মীয়ের মাধ্যমে ভিসা পাওয়ার পরও ২ লাখ টাকা কেন খরচ হচ্ছে প্রসেসিংয়ে, তাও জানেন না তারা। সৌদি আরব যেতে সরকার নির্ধারিত সাকল্যে ব্যয় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। তাদের কেন ৬ লাখ টাকা লাগছে- সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই।

আমিন ও সিদ্দিকের সঙ্গে আরও অন্তত ৫০ জন এসেছেন ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে। কারও স্পষ্ট ধারণা নেই। এর মধ্যে ফিঙ্গার প্রিন্ট শাখা থেকে বেরিয়ে আসেন আমিন ও সিদ্দিকের সেই এলাকার 'ভাই'। তার নাম বেলাল হোসেন। তার কাছে জানতে চাই, কেন দুই লাখ টাকা লাগে ভিসা প্রসেসিংয়ে? তার উত্তর, আল আমানা নামে এজেন্সি নিচ্ছে এ টাকা। তিনি শুধু প্রসেস করতে সহায়তা করছেন।
সরকারি নিয়মে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিবন্ধন বাবদ 'গামকা'য় দিতে হয় ৪০০ টাকা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাবদ দিতে হয় ৬-৭ হাজার টাকা, কল্যাণ তহবিলে ৩ হাজার ৫০০ টাকা, ফিঙ্গার প্রিন্টে ২২০ টাকা। আয়কর চালান ও অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে তা কিছুতেই ১০ হাজার টাকার বেশি নয়। আর বিমান ভাড়া বাবদ ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা।

সরকার নির্ধারিত ব্যয় বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ফি বাবদ দিতে হয় ৫ হাজার ১৪৮ টাকা। ভিসা ফি বাবদ ২ হাজার ৯৮৬ টাকা। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পায় রিক্রুটিং এজেন্সি। বিদেশ গমন প্রক্রিয়ায় ৫৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা কেন ব্যয় হয়- এ প্রশ্নে বেলালের দাবি, তিনি গ্রাম থেকে নিয়ে আসা কর্মীদের সহায়তা করেন মাত্র। সবকিছু এজেন্সি ও তাদের প্রতিনিধিরা জানেন।
কথা বলতে বলতেই পাওয়া গেল রায়হান আজিজ নামে এক যুবককে। তিনি আগেও সৌদি আরবে ছিলেন। সেখান থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা করেছেন। আবার যাচ্ছেন দেশটিতে। রায়হানের কাছ জানতে চাই, তার কত ব্যয় হলো বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে? তিনি জানালেন, সব কাজ তিনি নিজেই করছেন। ব্যয় হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। আমিন ও সিদ্দিকও জানতে পারলেন, শুধু বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়াতেই তাদের ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বেশি লেগেছে দালাল ধরার কারণে।

আমিন ও সিদ্দিকের মতো লাখো কর্মী দালাল ধরেই বিদেশে যায়। অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা সংস্থা 'রামরু'র প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কর্মী রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সঠিক প্রক্রিয়ায় বিদেশে যায়। বাকিরা যায় দালাল ও আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে। রামরুর গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ৫২ শতাংশ কর্মী দালালের খপ্পরে পড়ে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) 'দ্য হোমকামিং :প্রোফাইলিং দ্য রিটার্নিং মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স অব বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ৫১ শতাংশ কর্মীই দালাল ধরে বিদেশে যায়।
রামরুর প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ড. সিআর আবরার সমকালকে বলেন, দেশে কাজের অভাব। এ কারণেই টাকা যা-ই লাগুক, মানুষ বিদেশ যেতে মরিয়া। ঘর-বাড়ি বিক্রি করেও বিদেশ যেতে চায়। এ সুযোগই কাজে লাগায় দালালরা। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ জানে না, কোথায় কীভাবে বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। তাদের সচেতন করতে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই সরকারের তরফ থেকে। প্রবাসীকল্যাণ ভবনে কর্মীরা সহায়তা পাওয়ার বদলে হয়রান হয়। তাই দালালের শরণাপন্ন হতে হয়।

প্রবাসীকল্যাণ ভবনের সামনে অফিস সময়ে এক সপ্তাহ ধরে অবস্থান করে দেখা যায়, বিদেশগামী কর্মী মানেই 'টাকার খনি'! মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক ঢাকার দোহারের মো. শান্তর সঙ্গে সারাদিন থেকে দেখা যায়, প্রবাসীকল্যাণ ভবনের সামনের দোকানদার থেকে শুরু করে ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার কাছেই হয়রানির শিকার হয় বিদেশগামী কর্মীরা।
প্রবাসীকল্যাণ ভবনের বিপরীতে নাম নিবন্ধনের একটি ফরম বিক্রি হয় ৫০ টাকায়! অথচ তা অনলাইন থেকে ১ টাকায় প্রিন্ট করা যায়। কর্মীরা ৫০ টাকা দিতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন সেবা পেতে লাইন ধরতে হয় কর্মীদের। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কর্মীরা সেবা পেতে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেয় শুধু নিরাপত্তারক্ষী ও সেবা ডেস্কের কর্মচারীদের। বিকেলে বিদায়ের সময় সারাদিনের অভিজ্ঞতায় শান্ত বললেন, 'টাকা ছাড়া এখানে কিছুই হয় না। পদে পদে দালাল।'
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, কয়েক হাত বদল করে কর্মীদের রিক্রুটিং এজেন্সি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় দালালরা। বারবার হাত বদলের কারণে অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যায়।

প্রতারণার শিকার হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান অনির্বাণ ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক আল আমিন নয়ন গ্রামে গ্রামে তথ্যানুসন্ধানের অভিজ্ঞতায় সমকালকে বলেন, প্রতিটি প্রতারণার ঘটনায় দালাল ও অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি দায়ী। তারা প্রলোভন দেখিয়ে, চাকরির মিথ্যা তথ্য দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদ সমকালকে বলেন, কর্মীরা সরাসরি এজেন্সির কাছে আসে না। তাই তাদের মার্কেটিংয়ের জন্য লোক (দালাল) নিয়োগ করতে হয়, যারা টাকার বিনিময়ে কর্মীদের এজেন্সি পর্যন্ত নিয়ে আসে।
টিআইবির প্রধান নির্বাহী ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, রোজগারের জন্য বিদেশে যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়া এখনও দালালনির্ভর। মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। এ জন্য তাদের পরিচয়পত্র দেওয়া উচিত, যাতে তারাও নিয়ম-নীতির মধ্যে থাকে

 

http://samakal.com/bangladesh/article/17121023