১৮ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:১৩

শুধু ভোটই গণতন্ত্র নয়

দেখা অদেখা

সালাহউদ্দিন বাবর

গণতন্ত্র অর্থ শুধু ভোট দেয়া-নেয়া নয়। এর বহু ব্যঞ্জনা রয়েছে। অনেক কিছুর সমাহারেই গণতন্ত্র পূর্ণতা পায়। এক অর্থে জনগণের অভিপ্রায়ের প্রকাশকে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় বলে ভেবে নেয়া যেতে পারে। আজকে গণতন্ত্রের যে পরিশীলিত রূপ, তা দীর্ঘ সময় পথ চলার মধ্য দিয়েই এ অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। তবে এর আরো উৎকর্ষপর্যায়ে নিয়ে, পৌঁছানোর চিন্তাভাবনা থেমে গেছে তা নয়। বিজ্ঞজনেরা এর প্রয়োগপদ্ধতি নিয়ে চিন্তাভাবনা বন্ধ করে দিয়েছেন, এমনো নয়। তবে একই সাথে স্মরণ রাখতে হবে, বিশ্বের সবখানেই গণতন্ত্রের পরিশীলিত অভিন্ন রূপ বিরাজ করছে না। এমনকি বাংলাদেশেও গণতন্ত্র অনুশীলন প্রত্যাশিত মাত্রায় নেই। কখনো গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কিছু এগিয়েছে আবার কখনো পিছিয়েছে। এখানে গণতন্ত্রের যে চর্চা, তাতে কখনোই এর আদর্শিক অবস্থানকে অনুসরণ-অনুশীলন করা হয়নি। ক্ষমতাসীনেরা বরাবর নিজেরা যা মনে করেছেন তা-ই চর্চা করেছেন। জনগণের অভিপ্রায়-অভিমত কী, তা বোঝার বা জানার চেষ্টা করেননি। অথচ জন-অভিপ্রায় যে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় তা গুরুত্ব পায়নি। ফলে গণতন্ত্রের প্রশ্নে স্থায়ী কোনো আদর্শ এখানে প্রতিষ্ঠা পায়নি।
গণতন্ত্রের জন্য এ ভূখণ্ডে লড়াই দীর্ঘ দিনের। ১৯৪৭ সালের দিকে এর সূচনা, বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের স্বরূপ নিয়ে চলেছে পরীক্ষা। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্দেশ্য যে মহৎ ছিল, তা বলা যাবে না। কখনো পরোক্ষ ভোটব্যবস্থা, কখনো এক দলের প্রতিষ্ঠা করে তাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কখনো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক ব্যক্তি ও দলগুলোর ওপর জেলজুলুম নির্যাতন করা হয়েছে। নির্বাচনের নামে প্রহসন চালিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছে। এখন চলছে ভালো নির্বাচনের দাবিতে ভিন্নমাত্রার আন্দোলন। গণতন্ত্রের জন্য সবার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে, আমাদের দেশের রাজনীতিকে গণতন্ত্রবান্ধব করতে। দেশের রাজনীতিকেরা রাজনীতি করেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। আর ক্ষমতায় গিয়ে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করার কথা বলেন, নিজেদের চিন্তাভাবনা ও আদর্শের নিরিখে। নির্বাচনের আগে তারা নির্বাচনী ম্যানিফেস্টতে বহু কিছুর প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে বেমালুম ভুলে যান তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা।

গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে নির্বাচন। রাজনীতিকেরা কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সদস্য নয় বলে রাজনীতি থেকে কিছু প্রাপ্তির আশা করবেন। এই প্রাপ্তি ক্ষমতা, যশ এবং নিজের বা দলের আদর্শ অনুসারে কাজ করা। প্রত্যেক রাজনীতিক ক্ষমতা, যশের প্রত্যাশী হতে পারেন, এটি দোষের কিছু নয়! তবে এই আকাক্সক্ষা পূরণ করতে ইচ্ছে ব্যক্ত করলেই চলবে না। এ জন্য তাকে হাজির হতে হবে জনগণের মাঝে, জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাকে পছন্দ করতেও পারেন আবার না-ও পারেন। তার নীতি আদর্শকে জনগণ পছন্দ করলে তিনি ক্ষমতা যশের অধিকারী হতে পারেন। কিন্তু জনগণের পছন্দের প্রক্রিয়াটি হচ্ছে নির্বাচন তথা গণতন্ত্র। যারা রাজনীতি করেন, তাদের গণতন্ত্রে অনুশীলন পুরোমাত্রায় করতে হবে। জনগণের আস্থার প্রতি পুরো মাত্রায় শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। গণতন্ত্রের অর্থ শুধু যেনতেন ভোট নয়, সে ভোটব্যবস্থা হতে হবে বিতর্কহীন। সেই সাথে গণতন্ত্রের অনেক উপাদান রয়েছে। সে উপাদানকে অনুশীলন করতে হবে, যাতে রাজনীতি গণতন্ত্রবান্ধব হয়ে উঠতে পারে। আমাদের এখানের গণতন্ত্রের শুদ্ধাচারের অনুশীলন বা চর্চা হয় না। অনেক ভুলভ্রান্তি রয়েছে।

যে ভাষা আমাদের রাজনীতিতে বিদ্যমান, তাকে কোনোভাবে গণতান্ত্রিক আচরণভুক্ত করা যাবে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি যে ভাষায় কথা বলা এবং তাদের সমালোচনা করা হয় তা কোনোক্রমের সহযোগিতা তো নয়ই, এমনকি বৈরী সম্পর্ক যাদের সাথে তাদের প্রতিও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেকবার ভাবতে হবে। বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তাদের অনেক কিছু দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। কিন্তু লক্ষ করা যায়, তারা তাদের প্রতিপক্ষের বেলায় সুবচন নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঢালাও অশালীন মন্তব্য আসে তাদের কাছ থেকে। এতে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। এমন সব বক্তব্য রাজনীতির অঙ্গনকে উত্তপ্ত করে তোলে, যা পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত, জাতির কোনো ক্রান্তিকালে রাজনীতিতে ঐক্যের বড় প্রয়োজন হয়। ছোটখাটো এমন বক্র কথা ঐক্য সৃষ্টিতে কখনোই সহায়ক হয় না। রাজনীতিকদের আচরণ সেটা ভালো হলে তা গোটা পরিবেশকে ভালো করে, মন্দ হলে তা নেতিবাচক হয়ে থাকে। গণতন্ত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহিঞ্চুতা বজায় রাখা জরুরি। নীতি ও লক্ষ্যের প্রশ্নে মতভেদ কোনো মন্দ বিষয় নয়। আর তা থাকাটাও অযৌক্তিক নয়, তা না হলে পৃথক দলের প্রয়োজন হতো না। নীতি আদর্শ ও তা বাস্তবায়নের প্রয়োগপদ্ধতি নিয়ে ভিন্ন মতাবলম্বীদের সাথে তর্কবিতর্ক চলবে। আর লক্ষ্যটা ভিন্ন কোনো কারণে নয়, নীতি-আদর্শগুলোর জনবান্ধবতা নিয়ে। জনগণের কল্যাণের শুদ্ধপথ কোনটি তা নিয়ে কথা হবে।

এখানে নির্বাচনে বিজয়ীদের পরাজিত প্রতিপক্ষের ব্যাপারে অবজ্ঞা অবহেলা করতে দেখা যায়। তাদের সাথে কোনো সম্পর্কই আর বজায় রাখা হয় না। কিন্তু এটা মহৎ কোনো আচরণ নয়। মনে রাখা উচিত, যারা হেরে যান তারাও কিছু মানুষের কিছু সমর্থন পান। অনেক সময় এ সমর্থনের ব্যবধান একদম নগণ্য। তা ছাড়া, তাদের যারা সমর্থনকারী বা ভোটদাতা, তারাও তো এ দেশেরই নাগরিক। পরাজিতরা অবশ্যই জনগণের কিছু সমর্থন পেয়েছেন। সেই সব নাগরিকের ব্যাপারে যদি ক্ষমতায় যারা যাবেন তাদের শ্রদ্ধা না থাকে, তবে সরকার তো সবার সরকার হতে পারবে না। পরাজিতদের সব মত ও পথ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মতো নয়। গ্রহণযোগ্য সব মতকেই শ্রদ্ধা জানানো তো গণতন্ত্রের শিক্ষা। এই শিক্ষা অনুশীলন করতে না পারলে গণতন্ত্রের সুবাস-সৌন্দর্য তা বিকশিত হবে না। ক্ষমতাসীনেরা যদি এই বিষয়গুলো অনুসরণ করেন, তবে তাদের প্রতিপক্ষও তা অনুসরণ করতে উদ্যোগী হবেন। আর তা গণতন্ত্রকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে। একই সাথে যারা নির্বাচনে পরাজিত হন তাদের বিজয়ীদের শুভেচ্ছা জানানো উচিত, কেননা তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এই ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। অবশ্য এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। যে নির্বাচনে তারা বিজয়ী হন। সে নির্বাচন নিষ্কলুষ নয়, কারচুপি অনিয়ম করেই সাধারণত আমাদের এখানে বিজয়ী হয়ে থাকে। অতীতে এমন উদাহরণ রয়েছে। এমন নির্বাচনে যাদের হেরে যেতে হয়, তারা কথিত বিজয়ীদের শুভেচ্ছার পরিবর্তে বিষোদগার করে থাকেন। বিজয়ী দল জনগণের কাছ থেকে যে নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিয়ে আসেন তার আলোকে কাজ করা গণতন্ত্র অনুশীলনের একটি শর্ত। কিন্তু এখানে লক্ষ করা যায়, যে ওয়াদা করে বিজয়ীরা ক্ষমতায় আসেন সে ওয়াদা তারা যথাযথভাবে পূরণ করতে সচেষ্ট হন না। এটা গণতান্ত্রিক আচরণ নয়।

যথাযথভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠলে গণতন্ত্র দৃঢ় ভিত্তি পায়। দুর্ভাগ্য, এখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে গড়ে ওঠেনি বা বলতে হয় গড়ে তোলা হয়নি। জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিকেরা গণতন্ত্রের কথা মুখে বলেন, কিন্তু সেভাবে কাজ করেন না। যেমন দেশে বহু রাজনৈতিক দল রয়েছে। তারা সবাই গণতন্ত্রের ব্যাপারে সোচ্চার, কিন্তু নিজেরা দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা করেন না। প্রতিটি গঠনতন্ত্র রয়েছে, তাদের নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি রয়েছে, পদের মেয়াদ নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু এসবের চর্চা নেই। দলের একটি গঠনতন্ত্র থাকতে হয়, তাই যেন সেটা রয়েছে, এর বেশি কিছু নয়। নিজ ঘরে যদি গণতন্ত্রের চর্চা না থাকে, তবে ঘরের বাইরে গণতন্ত্র চর্চা তারা কিভাবে করবেন? গণতন্ত্রের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হবে যেকোনো দেশের নির্বাচন কমিশন। গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান যে ভোটব্যবস্থা, তাকে শুদ্ধভাবে সম্পন্ন করতে কমিশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেসব আইন-কানুন অনুসরণ করে নির্বাচন পরিচালনা করবেন সে বিধিবিধান যাতে সুষ্ঠু এবং অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সহায়ক হয় তা দেখতে হবে। কমিশন যারা পরিচালনা করবেন, তাদের অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হওয়া চলবে না। গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন সংবাদমাধ্যম বজায় থাকা একটি জরুরি অনুষঙ্গ। গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গতা পেতে হলে স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। মুক্তকণ্ঠে কথা বলতে না পারলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। জবাবদিহিতা গণতান্ত্রিক সমাজের আবশ্যকীয় একটি অঙ্গ। সংবাদপত্রের অন্যতম দায়িত্ব রাষ্ট্রের জবাবদিহিতি নিশ্চিত করা। আর জবাবদিহি নেয়ার মূল দায়িত্ব জাতীয় সংসদের। প্রশ্নমুক্ত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংসদ ও এর সদস্যরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনের জবাবদিহি নেবে। নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অনিয়ম জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ করছে কি না, সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছে কি না সংসদ তা দেখবে। আর এই সংসদ সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গঠিত কি না তা দেখবে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য নির্বাচন বিশুদ্ধ হতে হবে।

বাংলাদেশ এখন এমন একটি বিশুদ্ধ নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছে। এমন নির্বাচনের জন্য গোটা জাতি তাকিয়ে আছে নির্বাচন কমিশন, সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি। নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী। সে ক্ষমতা ব্যবহার করে কমিশন জাতির বিশুদ্ধ নির্বাচনের আকাক্সক্ষা পূরণ করবে। সেটাই সবার প্রত্যাশা। প্রায় ১০ বছর ধরে এমন দাবি নিয়ে বিভিন্ন রাজনীতিক ও পেশাজীবী নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন। যে নির্বাচনের পর রাষ্ট্রের নির্বাহী ও আইন বিভাগ ক্ষমতার চর্চা করছে, সে নির্বাচন নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কেউ সন্তুষ্ট নয়। এতে করে দেশের আর্থসামাজিক জীবনে স্থিতি বিনষ্ট হয়েছে। জনগণের গণতান্ত্রিক চর্চা তথা ভোটব্যবস্থা নিয়ে গভীর অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়েছে। একটি জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা খর্ব হয়েছে। গণতন্ত্র নিয়ে দেশের ভেতর এবং বাইরে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচিত প্রশাসন কর্তৃপক্ষ গঠনপ্রক্রিয়ায় ব্যত্যয় ঘটেছে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে জবাবদিহিতা থাকা দরকার, সেটা এখন বজায় নেই। যার ফলে সমাজে প্রতিকারহীন অনিয়ম-দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। যা এখন দেশের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। সরকারকে এসব বিষয়ে নির্লিপ্ত বলেই মনে হয়। এই সঙ্কটের মূলে যে গণতন্ত্রহীনতা, তা নিয়ে সরকার নীরব। অথচ দেশে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড় দায়িত্ব সরকারের, তা বাস্তবায়নের সরকারি উদ্যোগ দেখা যায় না। দেশে গণতন্ত্র কায়েমের ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য দলের বিশেষ করে বিরোধী দলের ভূমিকা থাকে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের সরকারিভাবে স্বীকৃত যে বিরোধী দল সংসদে রয়েছে, তাকে প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দল বলা যায় না। কেননা সে দলের সদস্যরা মন্ত্রিসভার সদস্য। তা ছাড়া সংসদে যে ভূমিকা তাদের তাতে সে দলকে বিরোধী দলের সদস্য বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। সংসদীয় কার্যক্রমে তারা সরকারি দলের মতোই ভূমিকা রেখে থাকে। সংসদে নেই, কিন্তু দেশের প্রধান বিরোধী দল তারা বরাবর অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি নিয়ে মাঠে ময়দানে সোচ্চার হয়ে আছে।
বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারি দল ও সব বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠান একটা রাজনৈতিক শিষ্টাচার। কিন্তু বাংলাদেশে এমন ঐতিহ্য নেই। যেমন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে একটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠান ছিল জাতীয় ঐক্য অর্জনের জন্য অতি প্রয়োজনীয়, কিন্তু সরকার এর প্রয়োজন অনুভব করেনি। অথচ রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি এবং সে আলোকে কর্মকৌশল গ্রহণ প্রয়োজন ছিল। এত বড় একটা সমস্যা একা সরকারের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। কিন্তু তেমন উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নে যে মতবিরোধ রয়েছে, তা দূর করার জন্য একটা জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠান ছিল জরুরি।
বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বহুবার এ দাবি করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা অবহেলাভরে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতি বর্তমানে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে তাতে সবার মধ্যে একটা আলাপ-আলোচনার ছিল বিশেষ প্রয়োজন। কিছু কিছু ঐতিহ্য তৈরি করতে হয় ভবিষ্যতের জন্য। যাতে আগামীতে প্রয়োজন মুহূর্তে তাকে ইতিহাস হিসেবে অনুসরণ করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে তেমন উদ্যোগের প্রয়োজন অনুভব করা হয় না।

রাজনীতিকেরা রাজনীতি করেন ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য। এ কথা তারা বলতেও পারেন যে, আগামীতে আমরা ক্ষমতায় যাব, কিন্তু এ বাক্য উচ্চারণ করার সময় একটা ‘যদি’ তাতে যোগ দিতে হবে। যেমন ক্ষমতায় যেতে চাই, যদি জনগণের সমর্থন পাই। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এখন সেই যদির ব্যবহার না করে, সরাসরি বলা হচ্ছে আগামীতে আমরাই ক্ষমতায় যাবো। এই বাক্যের মধ্যে একটা জবরদস্তির গন্ধ পাওয়া যায়; যা গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থী। জনগণ আশা করেন, দেশের মালিক আমরা, কারা রাষ্ট্রযন্ত্রের চালিকাশক্তি হবে, তাতে আমাদের সম্মতিটা একমাত্র শর্ত। কেউ জনগণের এই অধিকারের বিপরীতে কোনো বক্তব্য দেবে না, তা দেশের মালিকেরা আশা করেন। জনগণের সমর্থন না নিয়ে ক্ষমতায় গেলে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয় না। অথচ নির্বাচনের পরে স্থিতি আসবে এটাই সবার আশা। কিন্তু বাংলাদেশের সে আশা করা খুব কঠিন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/277355