১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৯:০৫

নরসিংদী আ’লীগ সদস্য সুইডেন আতাউরের অপকীর্তি

শত কোটি টাকার স্পিনিং মিল দখল

নরসিংদী শহরের বাগহাটায় ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে শত কোটি টাকা মূল্যের মোল্লা স্পিনিং মিল জবরদখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউরের বিরুদ্ধে মিল দখলের অভিযোগে থানায় মামলা করেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংক। বিপুল পরিমাণ ঋণের বিপরীতে দায়বদ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ দখলদার প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে উচ্ছেদ করছে না সংশ্লিষ্টরা।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে ১২৪ শতাংশ জমির ওপর সুতা উৎপাদনের শিল্প প্রতিষ্ঠান মোল্লা স্পিনিং মিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকার প্রকল্প ঋণ ও সাড়ে ৮ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণ দেয় সোনালী ব্যাংক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক আমজাদ হোসেন ভূঞার অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে লোকসানের কবলে পড়ে মিলটি। ফলে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবদুল মতিন মোল্লা ব্যক্তিগত গ্যারান্টি ও দায়দেনা থেকে অব্যাহতির শর্তে নিজের ও ২ সন্তানের সব শেয়ার আমজাদ হোসেন ভূঁইয়া এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করেন। শর্ত সাপেক্ষে মালিকানা পরিবর্তনের প্রস্তাব অনুমোদন করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই শর্তাদি পরিপালন না করায় এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে জালিয়াতি ও ঋণ মঞ্জুরিপত্রের শর্তানুসারে ব্যাংক ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ না করায় সোনালী ব্যাংক আমজাদ হোসেনদের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাতিল করে। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংক আবদুল মতিন মোল্লাকে মিলটির মূল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর মতিন মোল্লা মিলের দখল বুঝে নেন।

এদিকে মালিকানা জটিলতা চলাকালীন কারখানাটি দখলের ষড়যন্ত্র করেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউর। তিনি ২০১৩ সালে আমজাদ হোসেন ভূঁইয়ার কাছ থেকে কারখানাটি ভাড়া নেন। কিন্তু ব্যাংকের নির্দেশে মতিন মোল্লা কারখানাটির দখল বুঝে নিলে সুইডেন আতাউর সুকৌশলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে মতিন মোল্লার কাছ থেকে ২ বছরের জন্য পুনরায় কারখানাটি ভাড়া নেন। ভাড়ার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মালিকপক্ষ কারখানাটি ছেড়ে দিতে বললেও সুইডেন আতাউর তা মানছেন না, এমনকি ভাড়াও দিচ্ছেন না। উল্টো মোল্লা স্পিনিং মিলের সাইনবোর্ড ভেঙে সুইডেন বাংলা টেক্সটাইল মিলের সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছেন। এ ঘটনায় আবদুল মতিন মোল্লা নরসিংদী সদর থানায় মামলা করতে গেলে প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে মামলা না নিয়ে সাধারণ ডায়েরি হিসেবে তা গ্রহণ করে পুলিশ।

বিষয়টি জানার পর এ বছরের ২৬ মে ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল কারখানা পরিদর্শনে এলে তাদের বাধা দেয় সুইডেন আতাউরের লোকজন। ওই সময় ব্যাংকের প্রতিনিধি দলকে এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে সন্ত্রাসীরা। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে কারখানা পরিদর্শন করে প্রতিনিধি দলটি।

এ ঘটনায় ৩০ সেপ্টেম্বর মিলটির অবৈধ দখলদার আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউরসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সোনালী ব্যাংকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট বিভাগের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মোহাম্মদ বেলাল হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আসামিরা ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে ৩ বছর ধরে দখল করে রেখেছেন। তারা মেশিনারি ও যন্ত্রাংশসহ সমুদয় সম্পত্তির ক্ষতি করছেন। এবং মিলটি চালিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করছেন। এতে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের অর্থে কেনা এক কোটি টাকার যন্ত্রাংশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। অবৈধভাবে ব্যবহার করার কারণে ভবন ও মেশিনারিজের প্রায় ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

মোল্লা স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান আবদুল মতিন মোল্লা বলেন, আমজাদ হোসেন ভূঁইয়ার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি সংকটে পড়ে। ব্যাংকের নির্দেশ পাওয়ার পর আমরা নতুনভাবে কারখানাটি চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু সুইডেন আতাউর কৌশলে কারখানাটি দখল করে আত্মসাতের ষড়যন্ত্র করছে। তিনি রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে জোর করে কারখানাটি দখলে রেখেছেন। আমরা প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও প্রভাবশালীদের চাপে কেউ সহযোগিতা করছে না। এ অবস্থায় আমরা অবৈধ দখলদারের কাছ থেকে কারখানাটি ফিরে পেতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।

আমজাদ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, সুইডেন আতাউর আমার কাছ থেকে মিলটি ভাড়া নিয়ে এখন ভাড়াও দিচ্ছেন না। ভাড়া দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। এভাবে শুধু রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে একটি বৃহৎ শিল্প-কারখানা সুইডেন আতাউর অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। তবে আমজাদ হোসেন তার নিজের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেন।

অভিযুক্ত জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউর যুগান্তরকে বলেন, আমি আমজাদ হোসেন ভূঁইয়ার কাছ থেকে ১০ বছরের জন্য কারখানাটি ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছি। আমার কাছে বৈধ সব কাগজপত্র রয়েছে। ব্যাংক কেন দখলদার বলেছে তদন্তেই তা প্রমাণ হবে। ‘তাহলে ভাড়া দিচ্ছেন না কেন’- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজ যারা কারখানার মালিকানা দাবি করছে তারা মালিকানা ফিরে পাওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করেছে। সেই রায়ের আগে তারা মালিকানা দাবি করতে পারে না। জনপ্রতিনিধিদের কারণে তাদের ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।

ব্যাংকের দায়ের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নরসিংদী সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বিল্লাল হোসেন বলেন, প্রাথমিক তদন্তে সুইডেন আতাউরের দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। তিনি অবৈধভাবেই কারখানাটি জবরদখল করে পরিচালনা করছেন। এ ব্যাপারে দ্রুত আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।

 

https://www.jugantor.com/last-page/2017/12/17/180134