১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৯:০৩

গুম আতঙ্ক

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মানুষজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে অধিকাংশেরই খোঁজ মিলছে না

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মানুষজনকে তুলে নেওয়া হচ্ছে, পরে তাদের অধিকাংশেরই আর খোঁজ মিলছে না। বেশ কিছুদিন ধরে এই অপচর্চা চলে আসছে। যে গাড়িতে করে তাদের তুলে নেওয়া হচ্ছে, সেই গাড়ির নম্বর উল্লেখ করে মামলা দায়ের বা সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে থানা পুলিশ তা গ্রহণ করছে না। এ অবস্থায় সমাজের প্রায় সব স্তরেই গুম আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর যেসব পরিবার থেকে ইতোমধ্যে কেউ না কেউ গুম হয়েছেন, সেইসব পরিবারের বাকি সদস্যরা ভয়ানক আতঙ্ক ও মানসিক বিপর্যয়ে দিন কাটাচ্ছে। এই নিখোঁজের তালিকায় শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তি আছেন তা নয়। শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ সব পেশার মানুষই আছেন।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে গেলেই ওই ব্যক্তির পরিবার থেকে মনে করা হচ্ছে যে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, সে গুম হয়ে যাবে। ফলে পুরো পরিবার তখন থেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। আহাজারি করছে। নিখোঁজ ব্যক্তিকে ফিরে পেতে দৌড়ঝাঁপ করছে।

আবার সবাই যে গুম হচ্ছেন তাও নয়। ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ ফিরে আসছেন। তবে তারা কারো কাছে মুখ খুলছেন না। তাকে কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কোথায় তিনি ছিলেন, তার কাছে কী জানতে চাওয়া হয়েছে— এসব কোনো বিষয়েই তিনি কিছুই বলছেন না। কেন বলছেন না, তা তারা পরিবারের সদস্যরাও বলতে পারছেন না।

দু’একজনের পরিবারের সদস্যরা তাকে কী ধরনের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল, শুধু তার বর্ণনা দেন। তারা জানান যে, ছেড়ে দেওয়ার সময় তাকে এই বলে শাসিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কাউকে কিছু বললে পরে আর কোনো খোঁজ মিলবে না। ফলে সে যে জীবিত ফিরে এসেছে, তাতেই তারা খুশি। বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, এ নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করতেও রাজি নন।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ৫৪০ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ৫৫ জন ছিল এবং ২০১৬ সালে সেটি বেড়ে ৯৭ জনে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৪৫ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সব মিলিয়ে ৩৪৭ জনকে এখনো পাওয়া যায়নি। এদের ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউ কিছু বলতে পারে না। তবে অন্য একাধিক সূত্রের মতে, চলতি বছরের গত ১১ মাসে নিখোঁজ হয়েছেন দুই শ’র বেশি মানুষ। তারা কোথায় আছেন বা আদৌ বেঁচে আছেন কি-না সেটাও জানেন না পরিবারের সদস্যরা।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, গুম আতঙ্ক মানুষের মধ্যে ভয়াবহ ত্রাস সৃষ্টি করেছে। অনেকের মতে বিনা পরোয়ানায় আটকের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের ২০১৬ সালের নির্দেশনা মানলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো। একজন আইনজীবী বলেন, আদালতের নির্দেশনায় এমন কথাও রয়েছে যে, একজনকে গ্রেফতার করার পরপরই তার স্বজনকে, তার পরিবারের কাউকে অথবা তাদের কাউকে না পাওয়া গেলে গ্রেফতার করা ব্যক্তির চিহ্নিত করা কোনো বন্ধুকে জানাতে হবে যে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং কোথায় রাখা হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গুম পরিস্থিতি নিয়ে বলেছেন, ‘এমনও অভিযোগ আসছে যে, সরকারি বাহিনীর লোকজন সাদা পোশাকে বা কখনো ইউনিফর্মে অন্যের ভাড়া করা গাড়িতে বা নিজেদের গাড়িতে করে অনেককে তুলে নিয়ে আসছে। এভাবে তুলে নেওয়া ব্যক্তিদের অনেককেই আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।’

এ পর্যন্ত যারা ফিরে এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেছেন, তাকে একটি অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল। একটি জানালা থাকলেও সেখান দিয়ে খুব একটা আলো প্রবেশ করতো না। দরজার নিচ দিয়ে খাবার দেওয়া হতো। নির্যাতনের কথা খুব একটা বলেনি কেউ। অনেকে ফিরে আসার পরও বুঝতে পারেননি তাকে কেন ধরে নেওয়া হয়েছিল।

নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি তাদের ধরে না নিয়ে থাকে তাহলে তারা তাকে খুঁজে বের করুক। কিন্তু সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন আগ্রহ নেই বলে অভিযোগ করেন তারা। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনার পর থেকে এই ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে সন্দেহ আরো গভীর হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের সমাজে গুম নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক বিরাজ করছে। সবাই মনে করছেন, যে কেউ যে কোনো সময় গুম হয়ে যেতে পারেন। আমরা এক ভয়াবহ সংস্কৃতির দিকে যাচ্ছি। চালের দাম বাড়ার কারণে মানুষ যে পরিমাণ ক্ষুব্ধ, তার চেয়েও বেশি ক্ষুব্ধ এই গুমের সংস্কৃতির কারণে। একজন মানুষকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হবে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এই সংস্কৃতি দীর্ঘ সময় ধরে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। সরকারের উচিত এ ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা না থাকলে কারা এটা করছে তাদের খুঁজে বের করা। মানুষ এখন মনে করছে, সরকারেরই কোনো না কোনো সংস্থা এটা করছে। এ ধারণা যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে সরকারকেই সেটা ভাঙতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, যে সব ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত বা তাদের নাম করে তুলে নেওয়া হয় তখন পুলিশ মামলাও নিতে চায় না। এমনকি সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য দিয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে চাইলেও পুলিশ জিডি নিচ্ছে না। ফলে মানুষের সন্দেহ আরো বদ্ধমূল হচ্ছে।’

 

http://www.ittefaq.com.bd/national/2017/12/17/139862.html